এফএনএস : স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের কোন বিকল্প নেই। নুরুল হুদা কমিশন ইতোমধ্যে বেশ প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তাই নতুন নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষভাবে পরিচালিত করার জন্য যথাযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়ার দাবি জোরালো হচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠিত হয়েছে। এই কমিটির ঘাড়েই এখন এই মহান দায়িত্ব অর্পিত। নিরপেক্ষ মানুষ খুঁজে বের করে তাঁদের নাম প্রস্তাব করা। এটি যে তাঁদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। এই ছয় সদস্যের কমিটিকে বিধি অনুযায়ী, ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে যোগ্য ব্যক্তিদের নাম প্রস্তাব করতে হবে। কিন্তু বর্তমান ইসির মেয়াদ শেষ হতে আর বাকি আছে মাত্র ৯ দিন। এর মধ্যে দু’দিন ছুটি থাকায় কমিটির হাতে আছে সাত কর্মদিবস। এই সময়েই তাদের নিজেদের মধ্যে বৈঠক, রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবীদের সঙ্গে মতবিনিময়, সম্ভাব্য ব্যক্তিদের অনুসন্ধানসহ বিভিন্ন কাজ করতে হবে। ইসি গঠনে গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে হবে। পাশাপাশি নিজেদের নিরপেক্ষতা প্রমাণের চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হবে। বাংলাদেশ সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুসারে নির্বাচন কমিশন প্রধান নির্বাচন কমিশন এবং তাঁকে সাহায্য করার জন্য আরও চারজন অর্থাৎ মোট পাঁচ সদস্য নিয়ে গঠিত হবে। এই সাত কর্মদিবসের মধ্যে নতুন এই সার্চ কমিটিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ পাঁচ সদস্যের কমিশন গঠনের জন্য রাষ্ট্রপতিকে ‘নিরপেক্ষ ও যোগ্য’ ১০ জনের নাম সুপারিশ করতে হবে। এই ১০ জনের মধ্যে থেকে রাষ্ট্রপতি পাঁচজনকে নিয়োগ দেবেন, যাদের অধীনে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে ২০১২ সালের সার্চ কমিটি সময় পেয়েছিল ২৩ দিন; আর ২০১৭ সালে পেয়েছিল ১৫ দিন। এবারই প্রথম নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সংসদে আইন পাস হয়। গত ২৭ জানুয়ারি বহু তর্ক-বিতর্ক, দোষারোপ ও নাটকীয়তার পর ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’ জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। অবশ্য এতে নতুনত্ব কিছু নেই, মূলত এর মাধ্যমে অতীতের অনুসন্ধান কমিটি গঠনের প্রজ্ঞাপনকেই আইনের পোশাক পরানো হয়েছে মাত্র। অনেকের মনেই আইনটির উপযোগিতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে এবং তাঁরা এটির খোল নলচে বদলানোর পক্ষে। তবে এই আইনের নানা সীমাবদ্ধতা সত্তে¡ও বিশ্নেষকরা আশা করছেন, অনুসন্ধান কমিটির কাজ স্বচ্ছ হবে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সার্চ কমিটি গঠনকে স্বাগত জানানো হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এর কোনো মূল্য নেই। এটা জনগণের সঙ্গে প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও সার্চ কমিটির সদস্যদের ব্যাপারে সন্তুষ্ট নয়। দলটি বলেছে, অনুসন্ধান কমিটি কাদের নাম প্রস্তাব করে, সেটা দেখার অপেক্ষায় রয়েছে জাতি। আইনের ৪ (১) ধারায় নির্ধারিত অনুসন্ধান কমিটির দায়িত্ব ও কার্যাবলি সম্পর্কে বলা হয়েছে Ñ‘অনুসন্ধান কমিটি স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করিয়া দায়িত্ব পালন করিবে এবং এই আইনে বর্ণিত যোগ্যতা, অযোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, সততা ও সুনাম বিবেচনা করিয়া প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগ দানের জন্য রাষ্ট্রপতির নিকট সুপারিশ করিবে।’ কিন্তু প্রশ্ন উঠছে যে, সার্চ কমিটি বা অনুসন্ধান কমিটির সঠিক ব্যক্তিকে অনুসন্ধান করার কতটুকু সুযোগ থাকে? পক্ষপাতের উর্ধ্বে গিয়ে স্বচ্ছ ও যোগ্য সদস্য নির্বাচনের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন হবে কমিশনে নিয়োগ প্রদানের জন্য সম্ভাব্য ব্যক্তিদের নাম আহŸান করা। আইনের ৩ (৩) ধারায় বলা আছে, অনুসন্ধান কমিটি ‘রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠনের নিকট হইতে নাম আহŸান করিতে পারিবে।’ এ থেকে এটি স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, কমিটি অন্যান্যের কাছ থেকেও নাম আহŸান করতে পারবে। আইনের ৫ ধারায় নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের জন্য বাংলাদেশের নাগরিকত্ব, ৫০ বছর বয়স ও ২০ বছরের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে আইনের ৬ ধারায় দেউলিয়াত্ব, অপ্রকৃতিস্থতা, বৈদেশিক নাগরিকত্ব, যুদ্ধাপরাধে দন্ডপ্রাপ্তি এবং প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদে নিয়োগপ্রাপ্তিকে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। এসব যোগ্যতা-অযোগ্যতার মাপকাঠি পূরণ করে এমন হাজার হাজার ব্যক্তি বাংলাদেশে রয়েছেন, তাই কমিটির পক্ষে তাঁদের মধ্যে যেকোনো ব্যক্তিকেই রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করা ১০ জনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অনুসন্ধান কমিটির বিবেচনাধীন নামগুলো দুইবার প্রকাশ করা আবশ্যক। প্রথমবার বিভিন্ন সূত্র থেকে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের জন্য প্রস্তাবিত নামগুলো প্রাপ্তির পর এগুলো বাছাই করে একটি প্রাথমিক তালিকাÑযেমন ২০ জনের নামের তালিকা। তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের সম্মতি সাপেক্ষে, কমিটি গণবিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করারও পরামর্শ দিচ্ছেন তাঁরা। তাঁদের মতে, প্রাথমিক তালিকায় আসা ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ, শুনানিসহ বিভিন্নভাবে অনুসন্ধান পরিচালনার পর অনুসন্ধান কমিটি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণের জন্য যে ১০ জনের নামের চ‚ড়ান্ত তালিকা তৈরি করবে, তা একটি প্রতিবেদনসহ প্রকাশ করতে পারে। কোন যোগ্যতার কারণে এবং কোন যুক্তিতে তাঁরা চ‚ড়ান্ত তালিকায় স্থান পেলেন, তা এ প্রতিবেদনে থাকবে এবং চ‚ড়ান্ত তালিকা ও প্রতিবেদনটি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণের অন্তত তিন দিন আগে কমিটি এগুলো গণবিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করবে, যাতে জনগণ তাঁদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার সময় পান। উলেখ্য, সংবিধানের নির্দেশনা মেনে ইসি গঠনে আইন প্রণয়নের দাবি ছিল দীর্ঘদিন ধরেই। আইন না থাকায় প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিলুর রহমানের সময় থেকে সার্চ কমিটি গঠন করে নির্বাচন কমিশন গঠন শুরু হয়, যা অনুসরণ করেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। আগের দুই সার্চ কমিটি গঠনের সময় আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসেছিলেন রাষ্ট্রপতি। তবে গত দুই সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ায় বিএনপি এবার নিজেদের এই প্রক্রিয়ার বাইরে রাখছে। বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত এবারের সংলাপেও অংশ নেয়নি তারা। এখন তারা নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি জানাচ্ছে।