এফএনএস : চট্টগ্রাম বন্দর হচ্ছে দেশের প্রধানতম সমুদ্র বন্দর। ওই বন্দরে ক্রমেই জাহাজ আগমনের সংখ্যা বাড়লেও অবকাঠামোগত সক্ষমতা বাড়েনি। প্রতি বছরই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গড়ে ১২-১৫ শতাংশ আমদানি-রফতানি বাড়ছে। কিন্তু বন্দরের ১৯টি জেটির মধ্যে কোনোটির বয়স ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। এমনকি ৭০ বছরের বেশি পুরনো জেটিও রয়েছে। ফলে ওসব জেটি দিয়ে সামনের দিনগুলোয় বর্ধিত জাহাজের ভিড় সামাল দেয়া যাবে কিনা ওই বিষয়ে সংশয় রয়েছে। ব্যবসায়ী এবং চট্টগ্রাম বন্দর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, চট্টগ্রাম বন্দরের জেটি বা বার্থের কাঠামোগত অবস্থা খুবই নাজুক। ফলে ওসব জেটি দিয়ে পণ্য খালাসে অতিরিক্ত সময়ক্ষেপণ হয়। তাছাড়া প্রয়োজনীয় নাব্যতার অভাবে বন্দরটিতে বড় জাহাজ ভিড়তে না পারার কারণেও অনেক সময়ক্ষেপণ হয়। কারণ বড় জাহাজ থেকে তুলনামূলক ছোট বা ফিডার ভেসেলে করে পণ্য পরিবহন করতে গিয়ে প্রচুর সময় চলে যায়। তার মধ্যেই জেটি বা বার্থের অকুপেন্সি রেট বেশি হওয়ায় ফিডার ভেসেলকে বহির্নোঙরে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হয়। আর বন্দরের সক্ষমতার ওই ঘাটতির মাশুল ব্যবসায়ীদের গুনতে হয়। একদিকে পণ্য হাতে পেতে দেরি, অন্যদিকে অতিরিক্ত সময়ের জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। যদিও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের দাবি, বর্তমানে বন্দর থেকে পণ্যের লোডিং-আনলোডিং কার্যক্রমে অস্বাভাবিকভাবে কোনো সময়ক্ষেপণ হচ্ছে না। বহির্নোঙরেও জাহাজকে খুব একটা অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। সূত্র জানায়, জেটি বা বার্থ অকুপেন্সি রেট দিয়ে কোনো বন্দরের জেটিগুলোর সক্ষমতা পরিমাপ করা হয়। বন্দরে জেটিগুলোর মোট ব্যবহারযোগ্য সময়ের অনুপাতে কতোটুকু জাহাজের বার্থিংয়ের কাজে ব্যবহার হয়, সেটিকেই বার্থ অকুপেন্সি রেট বলা হয়। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও বিনিয়োগবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের মানদন্ড অনুযায়ী কোনো বন্দরে বার্থ অকুপেন্সি রেট ৭০ শতাংশের বেশি হলে সেখানে আগত জাহাজের ভিড় জমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। সেক্ষেত্রে ধরে নেয়া হয় বন্দরটির জেটির সক্ষমতা আগত জাহাজের সংখ্যার তুলনায় কম বা বন্দরটিতে জাহাজের বার্থিং সেবার মান যথাযথ নয়। আবার অকুপেন্সি রেট ৫০ শতাংশের নিচে হলে বন্দরটির সক্ষমতা অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে বলে ধরে নেয়া হয়। সেক্ষেত্রে আদর্শ বার্থিং অকুপেন্সি রেট হলো ৬০ শতাংশ। কিন্তু এদেশের অর্থনীতির লাইফলাইন হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রাম বন্দরে বার্থ অকুপেন্সি রেট ছিল ৮০ শতাংশেরও বেশি। বন্দরটিতে বার্থ অকুপেন্সির ওই হার প্রতিনিয়ত কমবেশি বজায় থাকছে। এমনকি ওই হার সামনের দিনগুলোয় আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। গত অর্থবছরেও চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাসের জন্য ৪ হাজারের বেশি জাহাজ এসেছে। বন্দরের প্রধান ১৯টি জেটিতে সীমিতসংখ্যক জাহাজ ভিড়তে পারে। অনেক জাহাজকেই বহির্নোঙরে নোঙর করতে হয়। তার মধ্যে তুলনামূলক বড় জাহাজগুলোকে কুতুবদিয়া বা বহির্নোঙরে এসে অপেক্ষায় থাকতে হয়। তার চেয়েও বড় জাহাজগুলো কুতুবদিয়ায় আসার পর লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে কিছু পণ্য খালাস করে হালকা করার পর বন্দর সীমানায় আসার অনুমতি মেলে। তার মধ্যে অকুপেন্সি রেট বেশি হওয়ায় বন্দরটিতে সময়ক্ষেপণের মাত্রাও বেড়ে যাচ্ছে। সূত্র আরো জানায়, বন্দরের বার্থ অকুপেন্সি রেট বেশি হলে তা আমদানিকারকদের বেকায়দায় ফেলে দেয়। সেক্ষেত্রে কাঁচামালের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ ঠিক রাখা যায় না। পাশাপাশি ব্যাংকঋণের সুদও বাড়তে থাকে। আমদানিকারকের পণ্য পাওয়ার অপেক্ষা যদি দীর্ঘ হতে থাকলে জাহাজের ভাড়াও বেড়ে যায়। শিপিং কোম্পানিগুলো অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করে। আর তার খেসারত ব্যবসায়ীদের পর ভোক্তা শ্রেণীকে দিতে হয়। এদেশের মোট বাণিজ্যের বড় অংশই তৈরি পোশাকের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে হয়। ওই বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা রফতানির পাশাপাশি পণ্যের কাঁচামালের জোগান নিশ্চিতে বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানিও করে। তাদের মতে, চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা পর্যায়ক্রমে বাড়লেও তা পর্যাপ্ত নয়। দেশের বাণিজ্য সম্ভাবনার সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এদিকে বিশেষজ্ঞরা চট্টগ্রাম বন্দরে নতুন জেটি নির্মাণের মাধ্যমে বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন। আবার কয়েক দশকের পুরনো জেটিগুলোর অবস্থাও এখন এতোটাই নাজুক যে, সেগুলোও ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করা প্রয়োজন। বন্দরে জেটির সংখ্যা না বাড়ালে চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে ব্যবসায়ীদের ভোগান্তি সামনের দিনগুলোয় আরো বাড়বে। বিনিয়োগবান্ধব অবকাঠামো উন্নয়ন নিশ্চিত করা ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের বিকল্প পথ খোলা না থাকার বিষয়টি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষও স্বীকার করেছে। তবে বর্তমানে বন্দরের উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান আছে। যদিও বর্তমানে কর্তৃপক্ষের হাতে থাকা প্রকল্প পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের যে অগ্রগতি, তাতে কাক্সিক্ষত সেবা পাওয়ার অপেক্ষা দীর্ঘ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে সমুদ্রপথে ভবিষ্যৎ বৈদেশিক বাণিজ্যের চাপ সামাল দিতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অধীনে নির্মাণের প্রক্রিয়ায় রয়েছে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি), মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প ও বে টার্মিনাল প্রকল্প। ওই প্রকল্পগুলো চালু হলে খুব অল্প সময়ের জন্যই হ্যান্ডলিং চাপ সামাল দেয়া যাবে। তবে মাতারবাড়ী বন্দর থেকে পণ্য খালাসের সুবিধা পেতে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের কমপক্ষে আরো চার বছর অপেক্ষা করতে হবে। চট্টগ্রাম বন্দরের পরিকল্পনাধীন বে টার্মিনাল প্রকল্পটি বন্দরের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ওই প্রকল্পটি নৌ-মন্ত্রণালয়ের নির্মাণ অনুমতি পাওয়ার ৮ বছর পার হয়েছে। কিন্তু এখনো কমন ইউজ ফ্যাসিলিটিজই নিশ্চিত করা যায়নি। ওসব কারণে জেটির অপ্রতুল প্রয়োজনের সময় চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম চালানোর পথে বিরাট প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক জানান, বন্দর থেকে পণ্যের লোডিং-আনলোডিং কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবেই চলছে। বহির্নোঙরে জাহাজকে খুব একটা অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের কার্যক্রমও খুব দ্রুত শুরু হতে যাচ্ছে।