এফএনএস : সৌদি আরবের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে করা দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত চুক্তিগুলোর দ্রুত বাস্তবায়নে জোর দেয়া হচ্ছে। বৈশ্বিক সঙ্কটের কারণে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে দেশের বিদ্যুত ও জ্বালানি খাত। ইতোমধ্যে চাহিদার তুলনায় কমানো হয়েছে বিদ্যুত উৎপাদন। জ্বালানির ওপর চাপ কমাতে বিদ্যুতে লোডশেডিং দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এটি কোন স্থায়ী সমাধান নয় বলে মনে করা হচ্ছে। এ কারণে বিশ্বের বৃহত্তম জ্বালানি তেল উৎপাদনকারী দেশ সৌদি আরবের কাছে প্রতিশ্র“ত বিনিয়োগের দ্রুত বাস্তবায়ন চায় সরকার। বাংলাদেশ-সৌদি আরব যৌথ কমিশনের (জেসি) ১৪তম বৈঠক সামনে রেখে বাংলাদেশ প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে বৈঠকের কার্যপত্র চূড়ান্ত করেছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। এতে সর্র্বোচ্চ জোর দেয়া হয়েছে বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতের ওপর। খবর সংশি−ষ্ট সূত্রের। জানা গেছে, জ্বালানি ও বিদ্যুত খাতে বিনিয়োগের জন্য কয়েক দফায় সৌদি আরবের সঙ্গে একাধিক চুক্তি করা হয়েছে। কিন্তু এ সংক্রান্ত কোন চুক্তি বা সমঝোতা স্মারকের কোন বাস্তবায়ন হয়নি। এছাড়া দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধিতেও সৌদি আরবের সঙ্গে একাধিক চুক্তি রয়েছে বাংলাদেশের। সর্বশেষ সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান আল সৌদ গত মার্চ মাসে ২ দিনের ঢাকা সফরে ঢাকা এসে ছোট বড় মিলিয়ে ১০টি প্রকল্পে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। অর্থাৎ এসব প্রকল্পে বিনিয়োগ শুরু হলে চলতি অর্থবছরের মধ্যে ১০ বিলিয়ন ডলার আসবে বাংলাদেশে। এর আগে ২০১৯ সালে বিদ্যুত ও শিল্প খাতসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে উন্নয়নের জন্য সৌদি আরবের সঙ্গে দুটি চুক্তি ও চারটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে তার কার্যালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এসব চুক্তি ও সমঝোতা হয়েছিল। এসব চুক্তি বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়বে। এতে করে অর্থনৈতিকভাবে দুই দেশই লাভবান হতে পারবে বলে মনে করছেন সংশি−ষ্টরা। বিশেষ করে দেশের বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতের চলমান সঙ্কট দূর হবে। এছাড়া সৌদি আরবের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ব্যবসা-বাণিজ্যেরও বড় সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য সংশি−ষ্টদের আরও দ্রুত কাজ করতে হবে বলে মনে করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তেল কোম্পানি আরামকো একটি তেল শোধনাগার নির্মাণ, পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণে আগ্রহ দেখিয়েছে। এর জন্য খরচ হবে দেড় থেকে ২ বিলিয়ন ডলার। সৌদি প্রতিষ্ঠান ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইমেনশন এলএলসি বাংলাদেশে বিনিয়োগের বিষয়ে অনেক বেশি উৎসাহী। প্রতিষ্ঠানটি ৭টি প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী এবং গত বছরের নবেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলনের সময় প্রায় ১ দশমিক ৬৮৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির নির্বাহী চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম বলেন, এ মুহূর্তে বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতে সৌদি আরবের বিনিয়োগ দ্রুত প্রয়োজন। দেশটির সঙ্গে যে কোন ফোরামে আলোচনায় এ বিষয়টির ওপর সর্বোচ্চ জোর দিতে হবে। তিনি জানান, ঢাকা ইস্ট-ওয়েস্ট এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে যেসব প্রতিষ্ঠান আগ্রহ দেখিয়েছে তাদের মধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইমেনশন অন্যতম। জানা গেছে, কিছু সৌদি বিনিয়োগ ইতোমধ্যে পাইপলাইনে রয়েছে। তার মধ্যে আছে পাবলিক প্রাইভেট অংশীদারিত্বে রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল দিয়ে পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনালের উন্নয়ন। কতটা সফলভাবে পাইপলাইনে থাকা কাজগুলো পরিচালনা করতে পারব তার ওপর আরও সৌদি বিনিয়োগ অনেকাংশে নির্ভর করবে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বনামধন্য জ্বালানি সংস্থা এসিডব্লিউএ পাওয়ার চট্টগ্রামে একটি ৭৩০ মেগাওয়াটের কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। যৌথ উদ্যোগে ১০০ মেগাওয়াট আইপিপি সৌর প্রকল্প নির্মাণে ১০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে চায় আল-ফানার। আল বাওয়ানি নির্মাণ ও প্রকৌশল প্রকল্পের জন্য দক্ষ মানবসম্পদের কর্মসংস্থানে প্রায় ১০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে আগ্রহী। যেসব খাতে সৌদি আরব বিনিয়োগ করতে চায় সেগুলোর মধ্যে আছে-জনশক্তি ও কর্মসংস্থান, দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়ন, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতসহ ধর্ম বিষয়ক খাত। বাংলাদেশ-সৌদি আরব যৌথ কমিশনের বৈঠকের প্রস্তুতি : বাংলাদেশ-সৌদি আরব যৌথ কমিশনের ১৪তম বৈঠকের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষে কার্যপত্র তৈরি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। আগামী ৩০-৩১ অক্টোবর সৌদি আরবের রিয়াদে অনুষ্ঠিতব্য ওই বৈঠকে বিদ্যুত, জ্বালানি, জনশক্তি রফতানি, উৎপাদিত পণ্যের রফতানি বাড়ানো, হালাল পণ্য বিশেষ করে মাছ-মাংস রফতানি, কৃষি প্রক্রিয়াজাতপণ্য রফতানি এবং সার উৎপাদনে সৌদি আরবের সহযোগিতা চাওয়া হবে। এছাড়া সৌদি আরবের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে করা এ পর্যন্ত যে চুক্তি করা হয়েছে সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়নে সৌদি আরবকে অনুরোধ করা হবে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ জানান, বাংলাদেশ-সৌদি আরবের যৌথ কমিশনের প্রস্তুতি নিয়েছে বাংলাদেশ। সৌদি আরবের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বিনিয়োগ সংক্রান্ত একাধিক চুক্তি রয়েছে বাংলাদেশের। এসব চুক্তি এখন বাস্তবায়ন হতে হবে। জানা গেছে, পেট্রোবাংলা এবং আরামকোর মধ্যে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সংক্রান্ত একটি চুক্তি হবে। এতে দেশের এলএনজি সঙ্কট দূর হবে। এছাড়া ইস্টার্ন রিফাইনারি ইউনিট-২ প্রতিদিন ৩ মিলিয়ন টন ক্রুড পামওয়েল প্রক্রিয়াজাতকরণে সৌদি আরবের সহযোগিতা চেয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে ৬৮ হাজার ব্যারেল রিফাইন্ড পেট্রোলিয়াম পাওয়া যাবে। বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড এবং বিশ্ববিখ্যাত এসিডব্লিউও পাওয়ারের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হবে। এতে দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে ব্যাপক অগ্রগতি হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সৌদি আরবের সঙ্গে ১০০ মেগাওয়াটের সৌর ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্ল্যান্ট (আইপিপি) নির্মাণ এবং ট্রান্সফর্মার ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ উৎপাদনের একটি চুক্তি রয়েছে। এসব চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়ন হওয়া প্রয়োজন বলে সংশি−ষ্টরা মনে করছেন। এদিকে সৌদি আরবের আরও ২০ কোম্পানি বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। সম্প্রতি সৌদি আরবের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি আরও বলেন, যত ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয়া দরকার, আমরা তাদের দেব। বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতার ক্ষেত্রে দুই দেশের আরও অনেক কিছু করার আছে। এছাড়া সরকারী-বেসরকারী অংশীদারত্ব বা পিপিপির ভিত্তিতেও দেশটি বিনিয়োগে আগ্রহী। মূলত বাংলাদেশের অবকাঠামো, চিকিৎসা, পর্যটনসহ বিভিন্ন খাতে সৌদি আরব বিনিয়োগ করবে। সৌদি আরবের সঙ্গে এ সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারী শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান কয়েক মাস আগে এ ধরনের একটি সমঝোতা স্মারকে সই করেছেন।