এফএনএস: দেশের যুবসমাজকে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক চর্চাসহ সমাজসেবায় আন্তরিক হওয়ার আহŸান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমরা যখনই সরকারে এসেছি চেষ্টা করেছি দেশের ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক জগৎকে উন্নত করতে। গতকাল শুক্রবার সকালে শেখ কামাল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কার ২০২২ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কথা বলেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ক্যাপ্টেন শেখ কামালের ৭৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, যারা ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক চর্চার জগতে সম্পৃক্ত থাকেন তাদের কারও কারও জীবন একটা সময় খুব দুর্বিষহ হয়ে যায়। শেখ কামালই প্রথম ক্রীড়া জগতে সম্পৃক্তদের সহযোগিতার জন্য ফান্ড গঠন করেছিল। আমি সরকারে আসার পর তাদের জন্য বিভিন্ন ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করে দিয়েছি, সিড মানি দিয়েছি এবং আরও ফান্ড জোগাড় করে দেবো যেনও তাদেরকে আর কষ্ট করতে না হয়। একটা বয়স আসলে তাদের আর অর্থ উপার্জনের সুযোগ থাকে না, সেটা যেন না হয় আমরা ব্যবস্থা নেব। খেলোয়াড়দের জন্য যেমন কল্যাণ তহবিল গঠন করা হয়েছে, সাংস্কৃতিক জগতের জন্যও আমরা করে দিয়েছি। শিল্প-সংস্কৃতির জগতের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত তাদের জন্য ট্রাস্ট ফান্ড করে আমরা সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছি। কাজেই যেকোনও আপদকালীন সময়ে তারা যেন চিকিৎসা বা অন্যকোনও সহযোগিতা পায় এই চেষ্টা আমরা করে যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল যে নীতি, আদর্শ, কর্মপন্থা, দিক-নির্দেশনা রেখে গেছেন, আমি মনে করি তা অনুসরণ করে আমাদের শিশু ও যুব সমাজ নিজেদেরকে গড়ে তুলবে। শুধু নিজের দেশের জন্য না, মেধা-মনন বিকশিত করে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও যেনও আমরা বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি করতে পারি সেভাবে আমাদের ছেলেমেয়েরা কাজ করবে- সেটাই আমি চাই। অনুষ্ঠানে পুরস্কার প্রাপ্তদের অভিনন্দন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, বিজয়ীদের দেখে আমাদের আরও বেশি সংখ্যক ছেলেমেয়ে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক চর্চায় ঝুকবে বলে আমি আশা করি। তিনি বলেন, আজকে কামাল আমাদের মাঝে নেই, আধুনিক ফুটবল খেলা এবং আবাহনী ক্রীড়া চক্র গড়ে তোলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন খেলাধুলায় ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে তরুণ প্রজন্মকে অন্তর্ভূক্ত করার একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছে কামাল। পাশাপাশি সংগীত চর্চায় স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করে বিভিন্ন দেশিয় গানকে আধুনিক বাদ্যযন্ত্রে তুলে তাকে জনপ্রিয় করার কাজটিও সে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করে গেছে। কেননা বহুমুখী প্রতিভা নিয়েই জন্মেছিলেন শেখ কামাল। প্রধানমন্ত্রী স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, বাসার ছাদে তাঁর সঙ্গীত দলের এই অনুশীলন চলতো যেখানে ফিরোজ সাঁই, ফেরদৌস ওয়াহিদ, নাসিরউদ্দিন সহ অনেকেই আসতো। জাতির পিতা হত্যার ৬ বছর পর দেশের ফিরতে সক্ষম হয়ে ধানমন্ডী ৩২ নম্বরের জাতির পিতার বাড়িটিকে তিনি মিউজিয়াম করলে সেখানে ফিরোজ সাঁই কামালের অর্গান, যেটি দিয়ে তিনি গান তুলতেন সেটি দিয়ে যায়। তাঁর সেই অর্গান এবং কামালের ‘সেতার’টি তিনি সেখানেই রেখে দিয়েছেন, বলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী বলেন, শেখ কামাল সেনাবাহিনীতে কমিশন পেলেও যেহেতু ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সম্মান শ্রেণীর লেখাপড়া তখনো শেষ হয়নি তাই মাষ্টার্স ড্রিগ্রী গ্রহণের জন্য সেনাবাহিনীর চাকরী ছেড়ে আবারো ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে সে ভর্তি হয়। কিন্তু মাস্টার্সের রেজাল্ট প্রকাশিত হবার আগেই না ফেরার দেশে চলে যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ কামাল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কার প্রবর্তনে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ জানিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন, এর ফলে মুক্তিযোদ্ধা এবং ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে শেখ কামালের অবদান সকলের মনে থাকবে। তিনি আরো বলেন, সাথে সাথে এটা আমি চাই আমাদের দেশের যুব সমাজ খেলাধূলা, সাংস্কৃতিক চর্চা ও সমাজসেবা সহ সবদিকে আরো উদ্যোগী হবে এবং নিজেদেরকে আরো বেশি সম্পৃক্ত করবে সেটাই আমার আকাঙ্খা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এজন্য তাঁর দল যখনই সরকারে এসেছে তখনই দেশের ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক জগতের উন্নতির প্রচেষ্ট চালিয়েছে। ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের দুঃস্থদের সেবায় শেখ কামাল যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেই পদাংক অনুসরণ করেই তাঁর সরকার সীড মানি দিয়ে বিভিন্ন ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করে দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় শেখ কামাল ভারতে গেলে দেশটির প্রধানমন্ত্রী তাকে লেখাপড়া করতে বললেও তিনি রাজি হননি বলে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ কামাল বলেছিলেন, আমি মুক্তিযুদ্ধ করতে এসেছি; ট্রেনিং নেব বলেও প্রধানমন্ত্রী জানান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কামাল মুক্তিযুদ্ধ যখন যায়, কামালকে কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন লেখাপড়া করার জন্য এবং তাকে সব ধরনের সহযোগিতা করবে। কামাল কিন্তু তাতে রাজি হয়নি। সে বলেছিল, আমি মুক্তিযুদ্ধ করতে এসেছি, আমি ট্রেনিং নেব। দেরাদুনে ওখান থেকে ট্রেনিং নেয় এবং ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধে যায়। শেখ হাসিনা বলেন, কামাল বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিল। একাধারে সে হকি খেলতো ফুটবল খেলতো ক্রিকেট খেলত, আবার সেতার বাজাতো, ভালো গান গাইতে পারতো, নাটকে অংশগ্রহণ করতো, অনেক নাটক তার করা ছিল। এত প্রতিভা এবং রাজনৈতিক সচেতনতা, যখন কলেজে পড়তো তখন থেকেই ছাত্রলীগের সে একজন সক্রিয় কর্মী ছিল। আমরা সবাই সংগঠন করতাম, আমাদের কখনো কোন পদ নিয়ে চিন্তা ছিল না। আমার বাবা যে রাজনীতি করতেন তার আদর্শ নিয়েই আমরা পথ চলতাম। তিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন যে সাদাসিধে জীবন যাপন করতে হবে। সেটাই আমরা করতাম, সেভাবেই চলতাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির ছেলে বা প্রধানমন্ত্রীর ছেলে, এ নিয়ে কোনো অহমিকা তার ছিল না। কামাল রাজনৈতিকভাবে সচেতন ছিল। জাতির পিতা ৭ই মার্চের ভাষণে যে ঘোষণা দিয়েছেন এবং সেই ঘটনাকে সামনে রেখে কামাল প্রত্যেকটা এলাকায় আমাদের নেতাকর্মীদের সংগঠিত করছিল। কামাল কাজ করত ১৯ নম্বর রোড আবাহনী ক্লাব, সাত মসজিদ রোডসহ ধানমন্ডি এলাকায় যুব সমাজকে নিয়ে সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকতো। ২৫ মার্চ সন্ধ্যা থেকেই ওই রাস্তায় বেরিকেট দেওয়ার জন্য কামাল বাসা থেকে চলে যায় এবং কাজ করতে শুরু করে। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের মানুষের ওপর গণহত্যা শুরু করে সেই সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, যেটা ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে সারা দেশে ওয়ারলেসের মাধ্যমে প্রচার করা হয় এবং সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। রাতে আমাদের বাসায় আক্রমণ করে আমার বাবাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়, আবার আক্রমণ করে। আব্বাকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেছে শুনে কামাল সেই আবাহনী ক্লাবের ওখান থেকে প্রায় প্রায় ৫০টা ওয়াল টপকে মাকে দেখতে আসো। কিন্তু ঐদিন রাতে আবার আমাদের বাড়িতে আক্রমণ করে। কামাল বাঙ্কারে আশ্রয় নেয় এবং সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধে চলে যায়। দেরাদুনে ট্রেনিং নেয় এবং ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধে যায়। পরবর্তীতে তাকে কর্নেল ওসমানী যিনি মুক্তিযুদ্ধে আমাদের প্রধান সেনাপতি ছিলেন তার এডিসি হিসেবে কামালকে নিয়োগ দেওয়া হয়। কামাল এবং মেজর নুর একই সাথে ওসমানীর এডিসি ছিল। ১৫ আগস্ট এই নুরই প্রথম আসে, কর্নেল ফারুকের নেতৃত্বে বাড়ি আক্রমণ করে, কর্নেল নুর, হুদা এরা আক্রমণ করে। কামাল গিয়েছিল তাদের দেখতে। ভেবেছিল বোধহয় রিসকিউ করতে এসেছে। ঘাতক হয়ে এসেছে সেটা বোধহয় জানতো না। প্রথম তারা কামালকেই গুলি করে। এরপর একের পর এক সবাইকে হত্যা করে। শেখ কামালের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগ আপ্লুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, শুধু ক্রীড়াবিদ না, একজন রাজনৈতিক নেতা হিসাবে তার অনেক দূরদর্শিতা ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ছিল, অত্যন্ত মেধাবী ছিল। আমাদের বাসায় সবসময় মানুষ দিয়ে ভরা থাকতো। পরীক্ষার আগে বন্ধুর বাসায় গিয়ে পড়াশোনা করতো যাতে ভালো রেজাল্ট হয়। আমরা পিঠাপিঠি দুই ভাই বোন, একসঙ্গে খেলাধুলা করতাম, ঝগড়া করতাম একই সাথে সাইকেল চালাতাম, একসঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলা পুতুল খেলা বল খেলা সমস্ত… এরকম সম্পর্ক আমাদের ছিল। আমার বাবা অধিকাংশ সময় জেলে থাকতেন, আমার মা আমাদের ভাই-বোনদের গড়ে তুলেছিলেন। আমার বাবার ক্ষমতা ছিল সত্য কিন্তু মা বলতো ক্ষমতার দিকে যেন নজর না দেয়, এভাবেই আমার মা আমাদেরকে গড়ে তুলতেন। কামালও এরকম সাদাসিধে জীবন যাপন করত। সুলতানার সঙ্গে যখন বিয়ের কথা হয়, প্রথমে তার আপত্তি ছিল, বলেছিল সে তো আমার ছোট বোনের মত। কিন্তু জামাল, রেহানা, রাসেল সবাই সুলতানার খুব ভক্ত ছিল। আমি অনেকটা কামালকে জোর করেই রাজি করিয়েছিলাম সুলতানাকে বিয়ে করার জন্য। দুর্ভাগ্য সেও জীবন দিয়ে গেল। আজকে কামাল আমাদের মাঝে নেই। আধুনিক ফুটবল খেলা আবাহনী ক্রীড়া চক্র গড়ে তোলা, বিভিন্ন খেলাধুলায় এ দেশের শিশু কিশোর থেকে শুরু করে যুবকদেরকে সম্পৃক্ত করা, সে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছে। পাশাপাশি স্পন্দন শিল্পগোষ্ঠী, সেখানে বিভিন্ন লোকসংগীত আধুনিক সুরের সঙ্গে মিশিয়ে সেগুলোকে জনপ্রিয় করা, এ কাজটা খুব দক্ষতার সঙ্গে করেছে। যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক হারুনুর রশীদ এবং স্পন্দন শিল্প গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য কাজী হাবলু স্মৃতিচারণমূলক বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে শেখ কামালের জীবন ও কর্মের ওপর নির্মিত ‘এক আলোর পথের যাত্রী’ শীর্ষক একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শিত হয়। প্রধানমন্ত্রী পরে শেখ কামালকে নিয়ে রচিত ’বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ক্যাপ্টেন শেখ কামাল আলোকিত তারুণ্যের প্রতিচ্ছবি’ শীর্ষক সচিত্র স্মারক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শহীদ শেখ কামালের ৭৩ তম জন্মবার্ষিকী ছিল গতকাল শুক্রবার। ১৯৪৯ সালের এই দিনে তিনি তদানীন্তন গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গীপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে বিপদগামী একদল সেনাকর্মকর্তার নির্মম বুলেটে মাত্র ২৬ বছর বয়সে জাতির পিতা ও বঙ্গমাতা সহ পরিবারের অধিকাংশ সদস্যদের সঙ্গে শাহাদাতবরণ করেন।