এফএনএস: কবি সৈয়দ শামসুল হক ‘একুশের কবিতায়’ লিখেছেন, ‘সভ্যতার মণিবন্ধে সময়ের ঘড়ি/শিশুর জন্ম থেকে জরাদেহ ক্ষীণশ্বাস মানবের অবলুপ্তির সীমারেখায়/বলে গেল সেই কথা। সেই কথা বলে গেল অনর্গল।’ কবিতা, গানে গল্পে আর উপন্যাসে মায়ের ভাষার প্রতি এমনই বিন¤্র শ্রদ্ধা জানিয়ে গেছেন কবি সাহিত্যেকগণ। এখনও মহান মাতৃভাষা আন্দোলন নিয়ে কবি সাহিত্যিকগণ লিখে যাচ্ছেন। মাতৃভাষার মাধ্যমে জীবন ও জগত সম্পর্কে যে গভীর বোধ জাগ্রত হয় তা আর বিদেশী কোন ভাষার মাধ্যমে তৈরি হয় না। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ‘অমর একুশের ষাট বছর’ শিরোনামে বাংলাভাষার ওপর একটি রচনা লিখেছিলেন। ২০১২ সালে বাংলা একাডেমি ওই স্মারকপত্র প্রকাশ করে। সেখানে মাতৃভাষার সর্বগামিতার প্রশ্নে তিনি অস্ট্রেলিয়ার কিম্বার্লি ল্যাঙ্গুয়েজ রিসোর্স সেন্টারের কর্মকর্তা জুন অস্কারের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আপনি নিজের অনুভ‚তি যেভাবে নিজের ভাষায় প্রকাশ করতে পারেন, সেভাবে ইংরেজিতে প্রকাশ করতে পারবেন না। আপনি অনুভব করতে এবং বুঝতে পারছেন কী বলা হচ্ছে, কিন্তু ঠিক তা মাথায় ঢুকছে না।’ একই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ থেকে উদ্ধৃত অনুচ্ছেদটি গভীর বোধ বাড়ানোর জন্য মাতৃভাষার সহায়তার প্রয়োজনীয়তার ওপর একটি চমৎকার ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। রবীন্দ্রনাথ জগদানন্দ রায়কে লেখা একটি চিঠিতে বলেছেন, ‘ছেলেরা মাতৃভাষা একটু একটু করে বাঁধ বেঁধে বেঁধে পাকা করে শেখে না। তারা যা জেনেছে এবং যা জানে না সবই তাদের ওপর অবিশ্রাম বর্ষণ হতে থাকে- হতে হতে কখন যে তাদের শিক্ষা সম্পন্ন হয়ে উঠে তা টেরই পাওয়া যায় না।’ মাতৃভাষার এই ‘অবিশ্রাম বর্ষণের’ কারণে ব্যক্তিগত চৈতন্য, বোধ, জাতিগত শিক্ষা, বোধগম্যসহ জাতীয় ধীশক্তি বাড়ে। সহজভাবে জিনিসটি বোঝানো যায় শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত করাচিতে ১৯৪৮ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে পাকিস্তানের গণপরিষদে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে যখন যুক্ত করার কথা বলেছিলেন, তখন তাঁর যুক্তি ছিল পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক (তখন ছয় কোটি ৯০ লাখ লোকের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের লোকসংখ্যা ছিল চার কোটি ৪০ লাখ) যারা বাংলায় কথা বলে। এত সংখ্যক লোকের জীবনবোধ গড়ে উঠবে বাংলা ভাষা তথা মাতৃভাষা ব্যবহার করার মাধ্যমে। পাকিস্তান আন্দোলন যখন দ্বিজাতি তত্তে¡র ভিত্তিতে পাকাপোক্ত হয়ে উঠতে লাগল, তখন বাংলা ভাষার অবস্থান নিয়ে বাঙালী বুদ্ধিজীবী মহলে সংশয় বাড়তে থাকে। ফলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পাওয়ার এক বছরের মধ্যে যখন ১৯৪৮ বা ’৪৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর ও ১ জানুয়ারি কার্জন হলে প্রথম পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, তখন ড. মুহম্মদ শহীদুলাহ তাঁর ভাষণে বললেন, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালী। এটি কোন আদর্শের কথা নয়, এটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ রেখে দিয়েছেন যে মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জো-টি নেই।’ ড. শহীদুলাহর বক্তব্যের ভিত্তি ছিল বাংলা ভাষা, তথা যে কোন ভাষার, নিহিত চরিত্র হচ্ছে অসা¤প্রদায়িক। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু-মুসলমান উভয়ে মাতৃভাষার মাধ্যমে জীবনবোধ, জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করবে এটা হবে মূল লক্ষ্য। সেখানে বাংলাকে গর্হিত করে রাখার প্রশ্নই ওঠে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে বাংলা ভাষায় ভাষণ দান করে এর আন্তর্জাতিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি হিসেবে এক আদেশে তিনি বলেন, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। তবুও অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে স্বাধীনতার তিন বছর পরও অধিকাংশ অফিস-আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজী ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালবাসা নেই, দেশের প্রতি যে তার ভালবাসা আছে এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।’ বঙ্গবন্ধুর এ ক্ষোভযুক্ত বাণী যে প্রেক্ষাপটে উচ্চারিত হয়েছিল, সে প্রেক্ষাপট যে এখনও খুব বদলেছে তা নয়। যা বদলাচ্ছে সেটা যে বাংলার প্রতি প্রীতি বা বাংলায় দক্ষতা বেড়ে গেছে বলে বদলাচ্ছে তা নয়, বেড়েছে ইংরেজীর প্রতি প্রীতি বজায় থেকে এবং নানা কারণে ইংরেজীতে দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে। অর্থাৎ ওই চেতনা এখনও কাজ করছে যে বাংলা ভাষার মাধ্যমে বুঝি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বুদ্ধির মুক্তি ও জ্ঞানের পথে দেশের কিছু মানুষকে নয়, সব মানুষকে সহযাত্রী করতে চাইলে বাংলা ভাষার ওপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই। ১৯৫২ সালে ঢাকার সঙ্গেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে চট্টগ্রামে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এই কমিটির আহŸায়ক ছিলেন মাহবুব-উল আলম চৌধুরী এবং যগ্ম আহŸায়ক ছিলেন চৌধুরী হারুনুর রশীদ এবং এম এ আজিজ। ৫২’র একুশে ফেব্র“য়ারিতে চট্টগ্রামের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হরতাল পালিত হয়। ঢাকায় ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণের খবর আসে চট্টগ্রামে অবস্থানরত কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সাংবাদিক-সাহিত্যিক খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের কাছে। জ¦র ও জলবসস্তে আক্রান্ত ছিলেন মাহবুব-উল আলম চৌধুরী। শ্রমিক নেতা চৌধুরী হারুনুর রশীদ এবং আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা এম এ আজিজ তাই আহŸায়ক হিসেবে কাজ করছিলেন। ঢাকায় ছাত্রজনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের খবরটা শোনার পর তিনি রচনা করেন ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ নামের কবিতা। অসুস্থতার জন্য মাহবুব-উল আলম চৌধুরীর হাতে লেখার ক্ষমতা ছিল না তখন। তিনি বলে যাচ্ছিলেন কবিতার পঙ্ক্তিগুলো আর সহকর্মী ননী ধর তা লিখে নিলেন। এটি হলো একুশের প্রথম কবিতা। আন্দরকিলায় কোহিনূর ইলেক্ট্রিক প্রেসে কবিতাটি পুস্তিকা আকারে প্রকাশের দায়িত্ব নিলেন খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস। উদ্দেশ্য ছিল সারারাত প্রেসে কাজ করে পরদিন সকালে গোপনে পুস্তিকাটি প্রকাশ করা। এক ফর্মার এই পুস্তিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ছিল শিরোনাম ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ এবং নিচে কবি মাহবুব-উল আলম চৌধুরীর নাম। প্রকাশক হিসেবে নাম ছিল কামালউদ্দিন খানের এবং মুদ্রাকর হিসেবে প্রেস ম্যানেজার দবিরউদ্দিন আহমদের। শীতের রাতে যখন কম্পোজ ও প্র“ফের কাজ প্রায় শেষের দিকে তখন পুলিশ সুপার আলমগীর কবীরের নেতৃত্বে একদল পুলিশ প্রেসে হানা দেয়। প্রেসে উপস্থিত কর্মচারীদের বুদ্ধিতে লুকিয়ে যান খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস এবং রক্ষা পায় সম্পূর্ণ কম্পোজ ম্যাটার। পুলিশ তন্ন তন্ন করে খোঁজ করেও কিছুই পেল না। কোহিনূর ইলেক্ট্রিক প্রেসের কর্মচারীরা গোপনে পুস্তিকাটির প্রায় ১৫ হাজার কপি বিক্রয় ও বিতরণের জন্য মুদ্রণ ও বাঁধাইয়ের কাজ শেষ করে। ঢাকায় গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ২৩ ফেব্র“য়ারি সমগ্র চট্টগ্রামে সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। লালদীঘি ময়দানে বিকেল ৩টায় অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় প্রতিবাদ সভার জনসমুদ্রে ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন চৌধুরী হারুনুর রশীদ। কবিতা শুনে বিক্ষুব্ধ জনতা স্লোগান দেয় ‘চল চল ঢাকা চল, খুনি লীগশাহীর পতন চাই’, ‘লীগ নেতাদের ফাঁসি চাই, নুরুল আমিনের কলা চাই’। এর কয়েকদিন পরেই সে সময়কার মুসলিম লীগ সরকার কবিতাটি বাজেয়াফত করে।