এম এম নুর আলম \ গ্রাম বাংলা থেকে বিলুপ্তির পথে প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতাকর্মী শকুন। এদের আকার চিলের চেয়ে বড়। শরীর কালচে বাদামি। পালকহীন মাথা, ঘাড়। কালো শক্তিশালী পা ও ঠোঁট। প্রচলিত আছে, এরা নাকি মৃত্যুর খবর আগে থেকে জানতে পারে। তাই এরা অসুস্থ ও মৃতপ্রায় প্রাণীর চারদিকে উড়তে থাকে। অপেক্ষায় থাকে কখন ওই প্রাণীটি মারা যাবে। এরা তী² দৃষ্টিসম্পন্ন। তাই এদের বলা হয় শিকারি পাখি। প্রশস্ত ডানা তাদের। তাই দ্রুত ডানা ঝাঁপটিয়ে চলাচল করতে পারে। এরা লোকচক্ষুর আড়ালে বট, পাকুড়, অশত্থ, ডুমুর প্রভৃতি বিশালাকার গাছে বাসা বেঁধে থাকে। অন্ধকার গুহা কিংবা গাছের কোটরে বা পর্বতের চূড়ায় এক থেকে তিনটি সাদা বা ফ্যাকাসে ডিম পাড়ে। পরিণত বয়সে দলবেঁধে আকাশে উড়ে। এরা তাল, শিমুল, দেবদারু, তেঁতুল ও বট গাছের মগডালে বসে থাকে শিকারের আশায়। এদের গলার স্বর খুবই কর্কশ ও তীষ্ট। দেখতে খুবই কুৎসিত। বলছি ‘বাংলা শকুন’ এর কথা। বাংলা শকুনের বৈজ্ঞানিক নাম জিপস বেজ্ঞালেনসিস। এই প্রজাতির পাখি বাংলাদেশের স্থায়ী বাসিন্দা। অথচ দুঃখের বিষয় হচ্ছে এই শিকারি পাখিটি আজ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। শকুন না থাকায় নদীতে, হাওড়ে ও উপকূলীয় চরে প্রায়ই গৃহপালিত জীবজন্তুর মৃতদেহ দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকতে দেখা যায়। বন-বাদাড় থেকে মৃতদেহ অপসারণের ক্ষেত্রে শকুনের কোনো বিকল্প নেই। যে শকুন প্রাণীর মৃতদেহ খেয়ে প্রকৃতিকে পরিষ্কার রাখে। তারাই আজ বিলুপ্তি হয়ে যাচ্ছে। পরিবেশ-প্রকৃতি বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা-ইইউসিএন এই শিকারি প্রজাতির শকুনকে ‘বিশ্ব মহাবিপণ্ণ’ পাখি ঘোষণা করেছে। কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশে ৭ প্রজাতির শকুন দেখা যেত। এর মধ্যে চার প্রজাতির শকুন এদেশের অনিয়মিত আগন্তুক। প্রজাতিগুলো হলো- ইউরেশিয়-গৃধিনি, হিমালয়ী-গৃধিনি, ধলা শকুন এবং কালা শকুন। বাকি তিন প্রজাতি বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করত। প্রজাতিগুলো হলো- বাংলা শকুন, সরসঠুঁটি শকুন ও রাজ শকুন। গত প্রায় ৪৫ বছরে সরসঠুঁটি-শকুন ও রাজ-শকুন বাংলাদেশ হতে পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন অল্প কিছু ‘বাংলা শকুন’ বেঁচে আছে। গত ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে দেশে পশুচিকিৎসায় বেদনাহর ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে ‘ডাইকোফেন’। পাশাপাশি মানুষের জন্য যে ডাইকোফেন আছে তাও গবাদি চিকিৎসায় ব্যবহার করা হচ্ছে। ডাইকোফেনের বিকল্প হিসেবে যে ‘কিটোপ্রোফেন’ ব্যবহার করা হয় তাতেও শকুন মারা যায়। ওইসব ওষুধ খাওয়া মৃত পশু খেয়ে মারা যাচ্ছে শকুন। ফলে দিন দিন আশঙ্কাজনকভাবে হারে কমে যাচ্ছে শকুনের সংখ্যা। কিছু দরকারি পদক্ষেপ ও কঠোর বাস্তবায়ন হলে শকুন বিলুপ্ত রোধ করা সম্ভব। যেমন-পশুচিকিৎসায় ‘ডাইকোফেনের’ ব্যবহার বন্ধের জন্য সরকারি নিষেধাজ্ঞাটি মাঠ পর্যায়ে কঠোরভাবে প্রয়োগ করা। মানুষের জন্য যে ডাইকোফেন রয়েছে, পশুচিকিৎসায় তার ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। কিটোপ্রোফেন ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে মেলোক্সিক্যাম ব্যবহার উৎসাহিত করা এবং শকুন না মারার জন্য প্রচারণা চালাতে হবে। তাহলেই চোখের সামনে অতি প্রয়োজনীয় ও অতুলনীয় এই পাখিটি বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত রোধ করা সম্ভব হবে।