এম এম নুর আলম \ সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের মাদুরের সুখ্যাতি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সেই সুখ্যাতি আজ ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ রয়েছে। কারণ হিসেবে দেখা গেছে, আগে জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের অধিকাংশ জমি পতিত থাকতো। সেখানে মাদুর তৈরির উপকরণ মেলে গাছ উৎপাদিত হতো। কিন্তু এখন জমির স্বল্পতা এবং উন্নত মানের বীজ পাওয়া যায় না। আগে নদীর ধারে চড়ায় বা খালের পাড়ে মাদুর বোনার কাঁচামাল মেলে উৎপন্ন হতো এবং সেখান থেকে মেলে সংগ্রহপূর্বক মাদুর তৈরি হতো। এক সময় জেলার মাদুরের সুনাম ছিল সুদূর ভারত পর্যন্ত। তখনকার দিনের হরেক রকম বুননি মাদুর দেশ-বিদেশের পর্যটকদের প্রতি আকৃষ্ট করতো। জেলার কয়েক হাজার পরিবার মাদুর তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করতো। তাদের পরিবারে ছিল না কোনো অভাব-অনটন। বর্তমানে মেলে গাছের তীব্র সংকটের দরুন মাদুর শিল্পে নিয়োজিত শিল্পীরা বেকার হয়ে পড়েছে। এখন তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। অনেকে বাপ-দাদার পেশাকে টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। তারা মেলের অভাবে উন্নতমানের মাদুর তৈরি করতে পারছে না। উপকরণের মূল্য বৃদ্ধির কারণে একটি মেলেকে দুভাগ করে মাদুর তৈরি করতে হচ্ছে। ফলে উন্নত মাদুর তৈরি করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। এখন আর ভালো বুনোনির মাদুর পাওয়া যায় না। জেলার মাদুর শিল্পে বর্তমানে যে অবস্থা বিরাজ করছে আগামীতে মাদুর শিল্প বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সর্বপ্রথম প্রয়োজন মেলে গাছ উৎপন্ন নিশ্চিত করা। সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলায় মেলে গাছ উৎপাদনের উপযুক্ত এলাকা রয়েছে। এ উপজেলার অনেক গ্রামের মানুষ এ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। এসব গ্রামের মধ্যে টেংরাখালী, মোকামখালী, তালবাড়িয়া, যদুয়ারডাঙ্গা, হেতালবুনিয়া ও কাদাকাটি উলেখযোগ্য। সরেজমিন দেখা যায়, এসব গ্রামের অনেক পরিবারের নারীরা মাদুর বুননের সঙ্গে যুক্ত। যাদের সংসারের একমাত্র আয়ের উৎস মাদুর উৎপাদন। কিন্তু প্রায় এক দশক ধরে মাদুর শিল্পের অবস্থা ক্রমাগত খারাপের দিকে যাচ্ছে বলে তারা জানান। এলাকায় মাদুর উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত মেলের উৎপাদন কমে গেছে। আশপাশে যা পাওয়া যাচ্ছে, তা অনেক বেশি দামে কিনতে হয়। ফলে মাদুর উৎপাদনে লাভ অনেক কমে গেছে। কয়েক বছর আগেও প্রতি কাউন মেলের দাম ছিল ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায়। ফলে এক জোড়া মাঝারি ধরনের মাদুর উৎপাদনে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা ব্যয় হচ্ছে। অথচ বাজারে এ মাদুরের প্রতি জোড়ার পাইকারি দাম ৬০০ টাকা। এতে এক জোড়া মাদুরে ৩০ থেকে ৪০ টাকার বেশি লাভ থাকছে না। ফলে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।তাছাড়া প্রযুক্তির কারনে মাদুর ব্যহারের প্রতি আগ্রহ কমছে জনসাধারনের। কয়েক বছর আগেও এসব অঞ্চলের নদীর তীরে প্রচুর মেলে চাষ হতো। কিন্তু এখন আর তা দেখা যায় না। দাম বেড়ে যাওয়ায় খরচ অনুযায়ী উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম পাওয়া যায় না। বর্তমানে মেলে গাছের তীব্র সংকটের দরুন মাদুর শিল্পে নিয়োজিত শিল্পীরা বেকার হয়ে পড়েছে। এখন তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। লবাণাক্ত মাটিতে মেলে উৎপাদন ভালো হয়। আশানুরূপ পরিকল্পিত উপায়ে মেলের চাষ করলে জেলার মাদুরের সুখ্যাতি ধরে রাখা যাবে। এখন যে মাদুর তৈরি করা হয় তা মোটেও উন্নতমানের নয়। আশাশুনি উপজেলার ঐতিহ্যবাহী বড়দল হাটে একদা হাজার হাজার মাদুর পাওয়া যেতো। শুধু মাদুরের খ্যাতির জন্য বড়দল বাজার সুখ্যাতি অর্জন করে। বর্তমানে এখানে মাদুরের বাজারের খুব করুণ অবস্থা। এলাকার নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা খেজুরের পাতার তৈরি মাদুর ব্যবহার করছে মেলের অভাবে। এখন সরকারি পদক্ষেপ ছাড়াও বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যেগ গ্রহণ করলে মাদুর শিল্পের ভবিষ্যৎ ফিরে আসবে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন।