মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ০১:০৩ পূর্বাহ্ন

আজ সাতক্ষীরা মুক্ত দিবস

দৃষ্টিপাত ডেস্ক :
  • আপডেট সময় বুধবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২২

স্টাফ রিপোর্টার ঃ পাকিস্তানী পতাকায় ছাত্র জনতার অগ্নি সংযোগ এবং অস্ত্র রূট ও ব্যাংক অপারেশন করে সংগৃহীত অর্থ নিয়ে ৭১ এর মার্চে সাতক্ষীরার সন্তানরা মাতৃভূমিকে শত্র“মুক্ত করতে যে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিল তারই সফল সমাপ্তি ঘটে ৭ ডিসেম্বর। ঐ দিন বীরের বেশে এই মাটির সন্তানরা বাংলাদেশের অর্জিত পতাকা কাঁধে নিয়ে সাতক্ষীরায় এসেছিল। চুমু খেয়েছিল মাটিতে আজ সেই ৭ ডিসেম্বর। বিজয়ের গৌরবের ৭১ এর এই দিনে যুদ্ধাহত মানুষ আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে পড়েছিল। দীর্ঘ নয় মাস ব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সেদিনের সাহসী সন্তানরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। পাক হানাদার ও তাদের দোসররা মা-বোনের ইজ্জত হরন করেছিল। ধ্বংস করতে চেয়েছিল বাঙ্গালীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে। শত্র“র বুলেটের এত সব আঘাত সহ্য করেও সাতক্ষীরার সন্তানরা অন্তত ঃ ৫০টি যুদ্ধের মোকাবেলা করেছিল। আক্রমন পাল্টা আক্রমণ শত্র“র ঘাটি দখল, শত্র“ বিতাড়ন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে ৭ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের সেই দিনটি ছিল আনন্দাশ্র“ মিশানো এক ঐতিহাসিক দিন। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোন সেক্টর গড়ে ওঠেনি তখনও। পরবর্তীতে গড়ে ওঠা ৯ম আর ৮ম সেক্টরের সাতক্ষীরার ভোমরা ছিল প্রথম ক্যাম্প। এখানেই সূচনা লগ্ন থেকে একটি প্রশিক্ষন ক্যাম্প গড়ে উঠেছিল তৎকালীন ই,পি,আর দের সহযোগিতায়। আর ওখানেই ২৯ এপ্রিল পাক বাহিনীর সাথে তরুন নবীন মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। দীর্ঘ ১৭ ঘন্টা উভয় পক্ষের গুলি বিনিময়ে পাক বাহিনী হারিয়েছিল তাদের কয়েক জন সেনাকে। আর দুই দফার যুদ্ধে শহীদ হয়েছিল তিন বীর যোদ্ধা। সাতক্ষীরা মুক্তিযোদ্ধাদের দেশাত্মাবোধ আর বীরোচিত যুদ্ধের ফলশ্র“তি হিসাবে ৭১ এর নভেম্বর শ্যামনগর কালিগঞ্জ শত্র“ মুক্ত হয়। অন্যদিকে ৭ ডিসেম্বর মুহিদ খান দুলুর নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী যোদ্ধাদল ধুলিহর ইউনিয়নের বেজেরডাঙ্গায় তখনও গেরিলা অপারেশনের পরিকল্পনা করছে। এরই মধ্যে খবর এলো পাক বাহিনী সাতক্ষীরা ছাড়তে শুরু করেছে। ক্ষিপ্রবেগে এই দলটি চলে এলেন সাতক্ষীরা শহরে। ক্যাম্প করলেন পিএন হাইস্কুলে ক্যাপ্টেন হুদার নেতৃত্বে আর একটি দল ঢুকে পড়ে সাতক্ষীরা শহরে। তারা থানা, ডাক বাংলোর, পিটিআইতে ঘাড়ি গাড়ে। এদিকে বীর যোদ্ধা আব্দুল­াহর নেতৃত্বে আরও একটি দল অবস্থান নেন, সাতক্ষীরা শহরে। এই ত্রিমুখী আক্রমণের পালা আসতে না আসতেই খবর এলো পাক বাহিনী ও দোশররা পিছু হটছে। বিজয় গৌরবে কাঁধে পিটে অস্ত্রের বোঝা আর ট্রিগারে আঙ্গুল রেখে যোদ্ধারা সদর্পে পুনঃ দখল করলেন তাদের প্রিয় মাতৃভূমি। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যে অনেক কে হতে হয় শহীদ। সবচেয়ে মারাত্মক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ৭ জুন প্রত্যুষে। দেবহাটা থানার টাউন শ্রীপুর। যে মহাপরিকল্পনা করে পাক বাহিনীর ব্যুহভেদ করার অঙ্গীকার করা হয়েছিল তা ফাঁস হয়ে যায়। এ সত্বেও মুক্তিকামী দামাল ছেলেরা সেদিন তাদের অস্ত্র দিয়ে শত্র“ সেনাদের জবাব পাল্টা জবাব দিয়েছিল। ৯ম সেক্টরের সদর দপ্তর টাকী থেকে তিনটি পৃথক গ্র“প তৈরি করে মুক্তিযোদ্ধারা ঢুকে পড়ে মাতৃভূমির মাটিতে। টাকীর ঠিক বিপরীতে টাউন শ্রীপুর এলাকায় অবস্থান ও টহলরত পাক সেনাদের নিশ্চিহৃ করে দেবার অদম্য ইচ্ছা শক্তি নিয়ে ক্যাপ্টেন শাহাজাহান মাষ্টারের নেতৃত্বে একটি গেরিলা গ্র“প অবস্থান নেয় ৬ জুন রাতে। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় পরদিন সুযোগ বুঝেই ওদের উপর আক্রমন চালানো হবে। কিন্তু উপর্যুপরি রাত জাগা যুব সেনারা কেউ তখনও ঘুমিয়ে কেউ বা নাশকতা করছে, এমনই এক পর্যায়ে খান সেনাদের তৎপরতা ধরা পড়ে। এ সময় একে অন্যকে সতর্ক করা চলতে থাকে। মুহুর্তেই আক্রমণাত্মক ছুটে যায় পাক বাহিনীর সদস্যদের দিকে। শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। মুহু মুহু গুলির রেঞ্জে পড়ে বেশ কয়েকজন পাক সেনা লুটিয়ে পড়ে। অপরদিকে শত্র“দের গুলিতে শহীদ হন কাজল, খোকন, নারায়ন ও এক ইঞ্জিনিয়ার ছাত্র সহ ৭ মুক্তিযোদ্ধা। ওদের রক্তের ভেসে যায় শুস্ক মাটি। বীরত্বপূর্ণ এ যুদ্ধে ব্রাশ ফায়ারে বেশ কয়েকটি গুলি বিধে যায় এরশাদ খান হাবলুর দেহে। সেদিনের ঐ যুদ্ধের স্মৃতিচারন করতে গিয়ে এরশাদ খান হাবলু বললেন ওরা শহীদ হয়েছিল এবং তিনি নিজে গুলি বিদ্ধ হয়েছিলেন বটে। কিন্তু এই সম্মুখ যুদ্ধে কামরুল ইসলাম খানের ভূমিকা ছিল খুবই বীরোচিত। পাক বাহিনীর অন্যতম খুটি মহকুমা হাকিম খালেদ মাহমুদকে গ্রেফতার, তার অফিসের পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে অগ্নি সংযোগ এবং বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন। ট্রেজারী থেকে অস্ত্র আর ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে অর্থ সংগ্রহ সহ মুক্তিযুদ্ধের সূচনা লগ্ন থেকে শেষ দিনটি পর্যন্ত কামরুল ইসলাম কান রেখেছেন অগ্রনী ভূমিকা। এই সেক্টরে যুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে রয়েছেন আইয়্যূব আলি, আলাউদ্দীন, সালাম, হাবলু, কামরুজ্জামান, এনামুল, গনি, রশিদ, আজিবর, খসরু, মোস্তাফিজ হাসনে জাহিদ জজ, মুজিবর, মোস্তাফিজ, স,ম বাবুর আলি সহ অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা তারা আজ স্ব স্ব অবস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে। কিন্তু শাহাদাত বরণকারী সেই সব সোনার সন্তানরা আজ অনেকেই লোকানতরে। দেশ মাতৃকার মুক্তি অর্জনে দক্ষিণ পশ্চিম বাংলার দুর্দান্ত প্রভাবশালী শার্দূল ক্যাপ্টেন শাহাজান মাষ্টার ও আজ লোকান্তরিত। মনে পড়ে তাদেরই কথা বারবার। কবর স্থান, স্মৃতি স্তম্ভ গুলি আজও অরক্ষিত কিংবা অবহেলার শিকার। আর তাই আনন্দ বেদনা যোগায় সেই সব যুদ্ধ ফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের। যখনই আসে ডিসেম্বর। ৭ ডিসেম্বর, সাতক্ষীরা মুক্ত দিবস।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2013-2022 dainikdristipat.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com