এফএনএস : রমজান মাস আসন্ন। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম এই মুসলিম দেশের বাজারে ইতোমধ্যে রমজানের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশে রমজান মাসে যখন জিনিসপত্রের দাম কমে, এই দেশে তখন বাড়ে। যারা বাড়ায় তারাও মুসলিম। তারাও রোজা দেয়। কি বিচিত্র ব্যাপার। সূত্র জানায়, রমজানের প্রায় দেড় মাস বাকি থাকলেও সংযমের ওই মাসটি ঘিরে প্রয়োজনীয় বেশকিছু পণ্যের দাম এরইমধ্যে চড়তে শুরু করেছে। অন্য বছরগুলোতে সবজির দাম শীতের ভরা মৌসুমে কম থাকলেও এবারের বাজারের ছবি ভিন্ন। সব সবজির দাম এবার বেশি। চাল-ডাল, পেঁয়াজসহ আরও কিছু পণ্যের দর আগে থেকেই লাগামহীন। আমদানিনির্ভর পণ্যগুলোর দামও বাড়ছে হুহু করে। নিত্যপণ্যের দর অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ায় ক্রেতারা পড়েছেন মহাবিপদে। এমনিতেই করোনার শুরু থেকে নিত্যপণ্যের বাজার অস্থির। এই অস্থিরতা রমজানে চরম পর্যায়ে উঠতে পারে বলে শঙ্কা করছেন অনেকে। নিত্যপণ্যের বাজারকে স্থিতিশীল রাখতে সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবি কমমূল্যে জিনিসপত্র বিক্রি করে আসছে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় তা খুবই নগন্য। ফলে বাজার স্থিতিশীল রাখতে টিসিবি খুব একটা ভ‚মিকা রাখতে পারছে না। জানা যায়, টিসিবি প্রতিদিন প্রকাশ করে বাজারদরের তালিকা। তাদের পণ্যের কমবেশির বাজারদর তালিকা ঘেঁটে দেখা যায়, এক সপ্তাহের ব্যবধানে ২০টি পণ্যের মধ্যে ১৭টির দামই বেড়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে চাল, আটা, ময়দা, পাম তেল, মুরগি, গরুর মাংস, চিনি, ডিম, জিরা ইত্যাদি। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা সয়াবিন তেলে। অল্প সময়ের ব্যবধানে নিত্য প্রয়োজনীয় এই পণ্যটির দাম তরতর করে বৃদ্ধি পেয়ে আকাশ ছুঁয়েছে। ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে স¤প্রতি বোতলজাত সয়াবিনের লিটারে আরও আট টাকা বাড়িয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাজারে এক লিটারের বোতল বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকায়। বোতলজাত সয়াবিন তেলের ক্ষেত্রে বোতলের গায়ে দর লেখা থাকলেও খোলা সয়াবিনে সে সুযোগ নেই। ফলে খোলা সয়াবিন আর পাম তেল বিক্রি হচ্ছে আরও বেশি দামে। খুচরা বাজারে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা এবং পাম তেল ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। কারওয়ানবাজারের এক খুচরা ব্যবসায়ী বলেন, ‘খোলা সয়াবিন তেল কেউ কেনেন আধা লিটার, কেউ এক লিটার। ফলে বোতলজাত সয়াবিনের চেয়ে খোলা সয়াবিন তেলের ক্রেতা বেশি। তবে সরবরাহ কম, তাই খোলা সয়াবিনের দাম বেশি।’ রমজানের প্রভাব পড়েছে পেয়াজের ঝাঁঝেও। দেশি পেঁয়াজের মৌসুম এখনও শেষ হয়নি। তারপরও ঝাঁজ বেড়েছে পণ্যটির। এক সপ্তাহ আগেও দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছিল ৩০ থেকে ৩৫ টাকায়। তিন-চার দিনের ব্যবধানে কেজিতে বেড়েছে ২০ টাকা। আর আমদানি করা পেঁয়াজের কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে হয়েছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। যা কয়েক দিন আগে পাওয়া যেত ৩৫ থেকে ৪৫ টাকায়। তবে জানা যায়, রমজানের বিষয়টি মাথায় রেখে সরকার টিসিবি পণ্যসেবা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। এ বিষয়ে স¤প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, আসন্ন রমজানে এক কোটি পরিবার টিসিবির পণ্য পাবে। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চেষ্টা করছি, যাতে কম মূল্যে মানুষ নিত্যপণ্য কিনতে পারে। রমজানে টিসিবি এবং ওএমএস’র মাধ্যমে এক কোটি পরিবারকে সহযোগিতা দেওয়া হবে। আমাদের প্ল্যান ছিল ৫০ লাখ মানুষকে (টিসিবির মাধ্যমে) সুবিধা দেওয়া। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এক কোটি পরিবারকে এ সুবিধার আওতায় আনা হবে। রমজানকে ঘিরে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির জন্য অসাধু ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেটদের পাশাপাশি সাধারণ ক্রেতাদেরও দায় আছে। বলতে গেলে প্রতি বছর রমজানের আগে নিত্যপণ্যের দাম আকাশচুম্বী হওয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের চেয়ে ভোক্তারাই বেশি দায়ী। এমনটি মনে করেন বিক্রেতা ও বাজার বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, রমজানে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পণ্য কেনায় বাজারে সংকট সৃষ্টি হয়। যার সুযোগ নেন এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। তাই বাজার স্থিতিশীল রাখতে কেনাকাটায় ভোক্তাদের আরও সচেতন হওয়ার পরামর্শ তাদের। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ক্রেতাদের মধ্যে এ সময়ে এক ধরনের আগে কেনার প্রবণতা থাকে। বেশিরভাগ ভোক্তার এমন প্রবণতাই দাম বাড়ার জন্য দায়ী। ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থা অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর সভাপতি গোলাম রহমান বলছেন, রমজানে পণ্য কেনার ব্যাপারে ক্রেতাদের আরও সহনশীল হওয়া জরুরি। বাজার অস্থিতিশীলতার কারণে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে জানুয়ারি মাসে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতির হার হয়েছে ৫ দশমিক ৬০ শতাংশ, যা ডিসেম্বরে ছিল ৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এ ছাড়া জানুয়ারি মাসে খাদ্যবহিভ‚র্ত পণ্যে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ২৬ শতাংশে, যা আগের মাসে ছিল ৭ শতাংশ। মূলত খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতির হার বাড়লেও খাদ্যবহিভ‚র্ত পণ্যে মূল্যস্ফীতির হার কমে আসায় সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার কমেছে বলে দাবি করছে বিবিএস। জানা যায়, নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিতে বেশি বিপাকে পড়েছেন গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষগুলো। দৈনন্দিন খরচ মেটাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন তারা। অল্পতেই তুষ্ট হওয়া এসব মানুষের মুখের হাসি হারিয়ে যাচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় অনেকে কোন ক‚লকিনারা পাচ্ছেন না। সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে ক্রমেই উৎকণ্ঠা বাড়ছে। জিনিসপত্রের দাম বাড়লে সাধারণত দেখা যায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মাচারীরা আন্দোলনে নামে ফলে তাদের বেতন বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সাধারণ মানুষের তো বেতন বাড়ছে না। তারা তো নিরুপায় হয়ে পড়ছে। এ বিষয়ে এক বেসরকারি কর্মচারীর ভাষ্য, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়ানো হয়েছে। সরকারের উচিত আমাদের মতো যারা ব্যক্তি মালিকানাধীন ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে তাদেরও সমানুপাতিক হারে বেতন বৃদ্ধির নির্দেশ দেয়া। ব্যক্তি মালিকানাধীন এমন অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে মানুষ মাসিক মাত্র ২ থেকে ৩ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করে। বর্তমান দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি থাকায় আমাদের মত নি¤œ আয়ের মানুষগুলো চরম দুর্ভোগের মধ্যে থাকতে হয়। কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমানও একই কথা বলছেন। তাঁর ভাষ্য, ‘সবার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। যারা বাজারে গিয়ে নিজেদের অসহায় মনে করে, তাদের সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। নতুবা সরকার শুনবে না।’