এফএনএস : দুর্নীতি বাংলাদেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। দুর্নীতিবাজদের দৌরাত্ম্যে দেশের অগ্রগতি হচ্ছে বাধাগ্রস্ত। এই দুর্নীতিবাজরা স্বাধীনতার পর থেকেই ছিল। তাদের কার্যপরিধি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। এদের দমন করতেই ২০০৪ সালে গঠিত হয়েছিল সংবিধিবদ্ধ সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, দুদক উৎপত্তির শুরুতে বেশ কিছু প্রশংসনীয় কাজ করেছে। কিন্তু সময় যতো গড়াচ্ছে দুদক ততোই নেতিয়ে পড়ছে বুড়ো বাঘের মতো। সংস্থাটির সেই তেজিভাব নেই, যা বিগত দিনে কমিশনের কাজে বেশ লক্ষণীয় ছিল। ওই সময়টায় রাজনীতিক, আমলা, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের দুর্নীতিবাজদের দিন কেটেছে আতঙ্কের মধ্যে। দুর্নীতি মামলায় জেলে যেতে হয়েছে অনেককে। অনেক আসামি দেশের ভেতরে পালিয়ে বেড়িয়েছেন। কেউ কেউ কৌশলে দেশ ছেড়ে গেছেন। দুদক বুড়িয়ে যাওয়ায় স্বভাবতই দুর্নীতিবাজরা চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। তারা এখন বেশ নিরাপদেই আছে। আরাম আয়েশে তাদের সুকর্ম সম্পাদন করে যাচ্ছে। সংশ্নিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, ধর-পাকড়ের ভয় না থাকায় অনেকের প্রকাশ্যে আনাগোনাও শুরু হয়েছে। বিগত দিনে সরকারি অফিসে ঘুষের প্রবণতা কিছুটা কমলেও এখন তা আবার পুরোদমে শুরু হয়েছে। অফিস, আদালত, বন্দরসহ সর্বত্র দুর্নীতি বাড়ছে। দুর্নীতিবিরোধী বিশেষজ্ঞরা দুদকের কাজে তেজিভাব ফিরিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু দুদক দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়বে কি দুদকের ভেতরেই দুর্নীতি জেঁকে বসেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অভিযানে জব্দকৃত অর্থ কোথায় যায় তা নিয়ে দেখা দিয়েছে প্রশ্ন। স¤প্রতি দুদকের এক কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা ও অভিযানে জব্দকৃত অর্থ তার নিজের হেফাজতে রাখার বিষয়টি সামনে এলে এ প্রশ্ন উঠতে থাকে। সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ১০ মার্চ কক্সবাজারে একজন সার্ভেয়ারের বাসায় অভিযান চালিয়ে র্যাব ঘুষের ৯৩ লাখ ৬০ হাজার ১৫০ টাকা জব্দ করে। সেই টাকা তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) হিসেবে শরীফ উদ্দিনের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। আলামত হিসেবে জব্দ করা টাকা তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত না করে এক বছর চার মাস নিজ হেফাজতে রেখেছেন।’ তবে অভিযোগটি অস্বীকার না করে দুদকের চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন বলেছেন, ‘জব্দ করা আলামতের টাকা তদন্তকারীর কাছে রাখা যাবে নাÑএমন বাধ্যবাধকতার কথা আইনে নেই।’ দুদক সচিবের অভিযোগ এবং শরীফ উদ্দিনের জবাবের পরিপ্রেক্ষিতে এখন যে বিষয়টি বড় হয়ে সামনে এসছে তা হলো: তদন্তকালে জব্দকৃত অর্থ কার হেফাজতে থাকবে, এ বিষয়ে দুদকের বিদ্যমান আইনে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা নেই। এ বিষয়ে দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক বলেন, ‘জব্দকৃত অর্থ দ্রুত সময়ে আদালতে দাখিলের নির্দেশ রয়েছে।’ দুদক সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, কমিশন আইনের বিধিমালার দুর্বলতা এবং স্পষ্ট নিদেশনা না থাকার কারণে তদন্ত কর্মকর্তারা জব্দকৃত টাকা তাদের নিজ হেফাজতে রেখে দেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দীর্ঘকাল ধরে তাদের হেফাজতে টাকা রাখার অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। আলোচিত কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিনের বিরুদ্ধে একটি অভিযানের জব্দকৃত টাকা নিজের জিম্মায় রাখাসহ আরো কিছু অভিযোগে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তবে শরীফ উদ্দিন দাবি করছেন তিনিসহ আরো অনেক কর্মকর্তাই কমিশনকে অবহিত করে টাকা নিজেদের জিম্মায় রাখতেন। শরীফের এ ঘটনার মত এমন অনেক ঘটনা আগেও ঘটেছে। তবে সে ব্যাপারে দুদকের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। দুদক কীভাবে পরিচালিত হবে তার সুনির্দিষ্ট কিছু নীতিমালা আছে। এই নীতিমালা গৃহীত হয় ২০০৭ সালে। জানা যায়, দুর্নীতি দমন কমিশন সৃষ্টি হবার পর থেকে কমিশন আইন এবং দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা-২০০৭ কয়েক বার সংশোধন হয়েছে। সর্বশেষ দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা-২০০৭ এর (সংশোধনী-২০১৯) ‘‘অপরাধলব্ধ সম্পত্তি অবরুদ্ধকরণ ও ক্রোক, ইত্যাদি” অধ্যায়ের ১৮ বিধি’তে সম্পত্তি অবরুদ্ধকরণ ও ক্রোকাদেশ জারি, অবরুদ্ধকরণ ও ক্রোকাদেশের মেয়াদ, অবরুদ্ধকৃত বা ক্রোককৃত সম্পত্তির জন্য রিসিভার, অবরুদ্ধকৃত বা ক্রোককৃত সম্পত্তি তৃতীয়পক্ষ দাবিদারের অনুক‚লে অবমুক্তকরণ, অবরুদ্ধকৃত বা ক্রোককৃত সম্পত্তির চ‚ড়ান্ত নিষ্পত্তির বিধি রয়েছে। তবে দুর্নীতি দমন কমিশনের অভিযানে উদ্ধারকৃত অস্থাবর সম্পত্তি বা অর্থ কার কাছে থাকবে বা কোথায় জব্দকৃত টাকা গচ্ছিত রাখা হবে সে ব্যাপারে স্পষ্ট কোন বিধি নেই। এমনকি কত দিন পর্যন্ত দুদকের তদন্ত কর্মকর্তার তত্ত¡াবধানে ওই অর্থ রাখা যাবে বা ওই অস্থাবর সম্পত্তি কতদিনের মধ্যে কী প্রক্রিয়ায় আদালতে উপস্থাপন করতে হবে সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট করা নেই। বিষয়টি স্পষ্ট না থাকায় এ সুযোগে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কতিপয় কর্মকর্তা স্বেচ্ছাচারিতা করছে বলে বিভিন্ন সময় দেখা গেছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ রয়েছে দুদকের অভিযানে অভিযুক্ত ব্যক্তির কাছ থেকে কী পরিমাণ টাকা বা অস্থাবর সম্পত্তি জব্দ করা হয় তারও রশিদ তদন্ত কর্মকর্তা সঠিক ভাবে দেন না। ফলে জব্দকৃত অর্থের পরিমাণ নিয়ে শুভঙ্করের ফাঁকি থাকতে পারে বলে অভিযোগ আছে। কিন্তু অবৈধ অর্থের মালিকরা ভয়ে এ ব্যাপারে মুখ খোলেন না। আদালত সূত্র জানায়, আদালত রায়ের মাধ্যমে দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় দুর্নীতিলব্ধ অর্থ-সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুক‚লে বাজেয়াপ্ত করে। কখনো বা মামলা বিচারাধীন অবস্থায় দুর্নীতিলব্ধ অর্থসম্পদ জব্দও করা হয়। বাজেয়াপ্ত এবং বাজেয়াপ্তকৃত সম্পত্তি সরকার তথা সরকার ভোগ-দখল করতে পারছে না। স্থাবর সম্পত্তিগুলো চলে যায় প্রশাসকের জিম্মায়। নগদ অর্থ ব্যাংকে বছরের পর বছর থাকে ‘জব্দ’ অবস্থায়। রাষ্ট্রের সম্পদ কাজে লাগাতে পারে না রাষ্ট্র। অব্যবহৃত অবস্থায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, বেদখল হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি দমন কমিশন মামলায বিচারিক আদালতে জয়লাভ করে বটে, কিন্তু সংস্থাটি রায়ের একটি কাগজ ব্যতীত সম্পত্তি সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্রই হাতে পায় না। রায়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত সম্পত্তির ওপর রাষ্ট্রের কার্যকর মালিকানা প্রতিষ্ঠা, ভোগদখল, সম্পত্তির যথাযথ ব্যবহার ও ভোগদখল নিশ্চিত হলো কি না দেখার নেই কেউ। জব্দকৃত সম্পত্তি বেহাত হয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রের ঘরে উঠছে না দুর্নীতি দমনের চ‚ড়ান্ত অর্জন। এ বাস্তবতায় রাষ্ট্রের সম্পদ রাষ্ট্র যাতে ব্যবহার কিংবা খরচ করতে পারেÑ বছর তিনেক আগে একটি উদ্যোগ নেয় দুদক। এ লক্ষ্যে গঠন করা হয় একটি ‘অ্যাসেট রিকভারি ও ম্যানেজমেন্ট ইউনিট’। কিন্তু সেই ইউনিটের কার্যক্রম দৃশ্যমান হয়নি তিন বছরেও। দুদকের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী পদক্ষেপ নেওয়ার কোন বিকল্প নেই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি তাঁদের মতে, দুদকের নীতিমালায় বাজেয়াপ্ত অর্থ সংরক্ষণের যে ধোঁয়াশা সেটিও দূর করা জরুরী।