জাহাঙ্গীর আলম কবীর লিলু প্রায় সারা দিন তার লেবু বাগানে ঘোরা ফেরা করেন। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বাগানে লোকজন খাটান। বিকেলের অবসরেও সময় কাটান আর স্বপ্ন দেখেন। বললেন, ‘গত বছরের তুলনায় এবার লেবুর ধরন কেমন হবে তা বুঝতে পারছিনে।’ লিলু এখন একজন সফল ফল চাষী। এখন পাকিস্তানি ও তেলা মালটা এবং দার্জিলিং কমলা লেবুর চাষ করছেন। তার লেবু বাগান দেখলে যে কেউ মুগ্ধ না হয়ে পারে না। ফল ধরেছে থোকায় থোকায়। তবে এখনো বেশ ছোট। ঘূর্ণিঝড় বুলবুল আর আম্পানের ধকল কাটিয়ে টিকে আছে তার দু’দুটো ফলের বাগান। লিলুর কমলা ও মাল্টা লেবু বাগান দেখতে আসেন বিভিন্ন এলাকার প্রকৃতি প্রেমিক মানুষজন। তার কাছে পরামর্শ নিতে আসেন দূরদূরান্তের ফল চাষিরাও। লিলুর পুরো নাম কামরুজ্জামান লিলু। বাড়ি সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বলাডাঙ্গা গ্রামে। পিতার নাম মাহবুবার রহমান, মাতা সুফিয়া খাতুন। এক সময় বেকারত্বের অভিশাপ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে কামরুজ্জামান লিলু ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের বিভিন্ন স্থানে। কিন্তু কোথাও নিজের ইচ্ছা মতো স্বাধীন ভাবে কাজ করার সুযোগ হয়নি। তাই বেছে নেন ফল চাষ। লিলু ২০১৫ সালে পরিবহনের চাকুরি ছেড়ে তার পুরো সময়টা বিনিয়োগ করেন এই ফল বাগানে। লিলু বলেন, ‘প্রথমে পেয়ারা ও কুল বাগান করার পরিকল্পনা করি। ২০১৮ সালে মাল্টা ও কমলা লাগাই।’ গত বছর লেবু বাগান থেকে তার সন্তোষজনক আয় হয়েছিল। ভেবেছিলেন তার বাগান থেকে ৬০০ ক্যারেট লেবু পাবেন। কিন্তু তার চেয়ে ২০০ ক্যারেট লেবু বেশি পেয়েছিলেন। অর্থাৎ ৮০০ ক্যারেট লেবু হয়েছিল। লিলু বলেন, ‘বাজার নরম থাকা সত্তে¡ও ভালোই লাভ হয়েছিল।’ এ বছর ৭ বিঘা জমিতে তার লেবু বাগান রয়েছে। তার বাগানে ৩৫০টি তেলা মাল্টা, ১৫টি পাকিস্তানি মাল্টা ও ২০০ দার্জিলিং কমলা গাছ রয়েছে। এবছর আরো ২৫০টি কমলা গাছ লাগানো হয়েছে। শুধু লেবু বাগান করতেই তার খরচ হয় ৩ লাখেরও বেশি টাকা। সঠিক পরিকল্পনা নিতে পেরেছিলেন বলেই সফলতার মুখ দেখেছেন। কামরুজ্জামান লিলু বললেন, এবছরও লাভের মুখ দেখবেন। লেবু বাগানে প্রতিদিন অসংখ্য শ্রমিক কাজ করে। তারা সকাল ৭টা থেকে ১২টা পর্যন্ত কাজ করে। ৫ ঘন্টা কাজ করে পুরুষ শ্রমিকরা পায় ২শ’ টাকা। আর নারী শ্রমিকরা পায় ১শ’ ৫০ টাকা। এভাবে লিলুর মাল্টা ও কমলা বাগানে এসব শ্রমিকরা নিয়মিত কাজ করছে। এরা বাগান পরিচর্যা, ফল তোলা, স্প্রে করা প্রভৃতি কাজ করে থাকে। লিলু জানান, ভরা মওসুমে আরও অনেক শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। কামরুজ্জামান লিলু নিজ গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী, তুজলপুর জিসি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং ২০০৩ সালে কলারোয়া আমনুল্লাহ ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। লেখাপড়া বলতে এখানেই শেষ। তারপর বেকার। ২০০৭ সালে চাকুরি নেন একটি ওষুধ কোম্পানীতে, এমপিও পদে। ২০১০ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত চাকুরি করেন চিটাগাং ইপিজেড-এ স্টোর কিপার হিসেবে। সর্বশেষ চাকুরি করেন সাতক্ষীরা ঢাকা চলাচলকারী এসপি গোল্ডেন লাইন পরিবহনে। পরিবহনে চাকুরি করার পাশাপাশি শুরু করেন পেয়ারা ও কুল চাষ। ২০১৩ সালে মাত্র ৩ বিঘা জমিতে পেয়ারা ও কুল গাছ লাগান তার বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরে নেহা গ্রামের মাঠে। বাগান লাগান জমি লিজ বা হারি নিয়ে। দেখতে পান আশার আলো। চাকুরি ও ফলের চাষ চলতে থাকে দু’টোই এক সাথে। পরের বছর চাকুরি ছেড়ে ১৪ বিঘা জমিতে শুধু পেয়ারা বাগান লাগান। নিজের টাকা ছিল না। তাই ঋণ দিয়ে তাকে ব্যাপক সহযোগিতা করেন তার মামাতো ভাই তৌহিদুর রহমান। প্রতি বছর প্রতি বিঘা জমি ১৫ হাজার থেকে ১৮ হাজার টাকা হারির মূল্য ধার্য করে ২৬ বিঘা জমি লিজ নেন। সবটাই দশ বছর মেয়াদী। এরপর পরিকল্পনা নেন মাল্টা ও কমলা লেবু চাষ করার। এবার নেহার পাশে রামেরডাঙ্গা গ্রামে সাড়ে ১৪ বিঘা জমি লিজ নেন। লিজের হারির মূল্য প্রতিবিঘা ১৮ হাজার টাকা। ২০১৮ সালে জমি সংগ্রহ করে লাগান নাগপুরী কমলা, চাইনিজ কমলা ও মাল্টা লেবু। সাথী ফসল হিসেবে লাগান পেয়ারা ও কাগুজি লেবু। কিন্তু নাগপুরী কমলার ফলন ও গুনগত মান ভাল হয়নি তাই গাছ কেটে ফেলে লাগান দার্জিলিং কমলা। থোকায় থোকায় কমলা ও মাল্টা দেখে লিলুর মনটা ভরে যায়। ফল বাগানে তিনি নিজে খাটেন, আরও ২০ থেকে ২৫ জনকে খাটান। কামরুজ্জামান লিলুর ক্ষোভ, তার বাগানে রোগ বালাই দেখা দিলেও তিনি কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কোনও সাহায্য কিংবা পরামর্শ এ পর্যন্ত পাননি। এই অফিসের কারো কোনদিন দেখাও মেলেনি। তাই তিনি বিভিন্ন চাষিদের কাছ থেকে পরামর্শ নেন। কীটনাশক কোম্পানী সিনজেন্টা ও গেøাবাল ইনভেফা কোম্পানীর লোকেরাই ক্ষেতে গিয়ে পরামর্শ দিয়ে আসেন। পরামর্শ নিতে নিতে তিনি অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। নিজেই এখন অন্য ফল চাষিদের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তার নিজের এবং অন্যের প্রয়োজনে মাধবকাটি বাজারে দিয়েছেন কীটনাশক, বালাইনাশক ও ছত্রাকনাশকের দোকান। একই সাথে বিক্রি করেন শাক-সবজির বীজ। লিলুর বাগানে বাড়তি ফসল হিসেবে আরও চাষ করেন চাষ করা হয় বেগুন, ঝিঙে, উচ্ছে, করলা, লাউ, কুমড়ো, চাল কুমড়ো, বরবটি, পুঁইশাক সহ বিভিন্ন ধরণের সবজি। এতে করে তার বাজার থেকে সবজি কিনে খেতে হয় না। বরং তার বাগানের শ্রমিক ও অন্যদেরকেও বিনা মূল্যে দেন। বেশি হলে মাঝে মাঝে বাজারেও বিক্রি করেন। কামরুজ্জামান লিলু বললেন, ‘লেবু চাষ আমাকে নতুন পথের সন্ধান দিয়েছে। আল্লাহর রহমতে নিজে ভাল আছি এবং আর ২০টি পরিবারকে সহযোগিতা করতে পারছি।’