এফএনএস: রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নদী দখলের চিত্র তুলে ধরে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তুরাগ নদীর তীরে সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সহযোগিতায় অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠান করা হয়েছে নদী ভরাট করে। এর সঙ্গে সরকারের লোকজন জড়িত। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ারস ইনস্টিটিউটে এক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন। নদী নিয়ে সরকারের কোনো পরিকল্পনা নেই-এমন মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, এ সরকার উন্নয়নের ঢাক ঢোল পিটিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নদীকে পরিশুদ্ধ করার, সঠিকভাবে প্রবাহিত করার কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই। বুড়িগঙ্গার দুরদর্শার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, বুড়িগঙ্গা দিয়ে যাওয়া তো দুরের কথা-এতটাই দুর্গন্ধ যে, এর পাশ দিয়েও যেতে পারবেন না। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সরকারের মাথাব্যথা নেই দাবি করে ফখরুল বলেন, গণতন্ত্র নেই বলেই জনগণের কাছে তাদের জবাবদিহি নেই। আর জবাবদিহি নেই বলেই ক্ষমতাসীনরা দেশের ন্যায্য হিস্যা আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের লক্ষ্য একটাই, সেটা হলো জোর করে হলেও ক্ষমতায় টিকে থাকতে হবে। ক্ষমতায় থাকতে তারা যা খুশি তাই করছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের মানুষকে টিকে থাকতে হলে গণতন্ত্র ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। দেশের ভেতরের বিশেষ করে ঢাকার আশপাশের নদী দখলের জন্য ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা জড়িত বলেও দাবি করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, ক্ষমতাসীনদের প্রশ্রয়ে তাদের লোকজনই নদীগুলো দখল করছে। এ ছাড়া বর্তমান সরকার উন্নয়নের ঢাকঢোল বাজায় প্রতিনিয়ত। কিন্তু নদী পরিশুদ্ধ করার বা নদীগুলোকে সঠিকভাবে প্রবাহিত করার সুযোগ করার জন্য তাদের কোনো পরিকল্পনা এখন পর্যন্ত আমার চোখে পড়েনি। মির্জা ফখরুল বলেন, লন্ডনে গেলে দেখবেন, তারা টেমস নদী কীভাবে পরিশুদ্ধ করেছে। ফলে এত বড় একটা শহর হওয়া সত্তে¡ও টেমস নদীর পানি এতটুকু দূষিত হয়নি। অথচ আমাদের বুড়িগঙ্গার পাশ দিয়ে যাওয়া যায় না। দুর্গন্ধের কারণে নদীর ওপর দিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, পাশ দিয়েও যাওয়া যায় না। আর তুরাগে গেলে দেখা যায় তুরাগ মরে গেছে! এখন শুরু হয়েছে ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যা। এগুলোও মৃত্যুর দিকে চলে যাচ্ছে! এ ছাড়া সাভার ও ধামরাইয়ে ছোট ছোট যে নদীগুলো আছে, সেগুলোও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের জীবন-জীবিকার সঙ্গে যে বিষয়গুলোর অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক, সেগুলোকে আমরা নিজেরাই ধ্বংস করছি। তিস্তা নিয়ে সরকার ভারতের সঙ্গে কোনো কথা বলেনি। ফলে উত্তরাঞ্চল মরুভ‚মিতে রূপান্তর হতে যাচ্ছে। সরকার ন্যায্য হিস্যা নিয়ে কোনো প্রতিবাদ করে না, বরং টিপাইমুখ নিয়ে প্রতিবাদ করায় হয়তো বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হয়েছেন। এ সময় বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আন্তর্জাতিক নদী থেকে ভারত পানি প্রত্যাহার করায় বাংলাদেশ নিজেদের পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে ও জেনেশুনে বাংলাদেশকে নদীর পানি থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করছে। খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে নদীর ওপর অপরিকল্পিতভাবে সেতু ও শিল্প-কারখানা করা হচ্ছে। অন্য কোনো দেশকে খুশি করার জন্য এসব করছি। এতে নদীর বিশাল ক্ষতি করছি। ভারত প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, তারা তিস্তা নদীর পানি প্রত্যাহার করছে। দেশের জনগণের স্বার্থে নদীর প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। ভারতের সঙ্গে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনের আলোচনায় মাথা উঁচু করে দর-কষাকষি করা উচিত বলেও উল্লেখ করেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন। ‘জলবায়ু পরিবর্তন: বাংলাদেশ ও নদী’ শীর্ষক এই সেমিনারে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ভারত বাঁধ নির্মাণ করে নদীর পানি প্রত্যাহার করায় নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ বাঁচলো কী মরলো, সেটা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। বছরে চার বার যৌথ নদী কমিশনের সভা হওয়ার কথা, কিন্তু বছরের পর বছর কোনো সভা হয় না। সরকারকে মেরুদÐ সোজা করতে হবে। পানির ন্যায্য হিস্যা গ্যারান্টি করে আদায় করতে হবে। সেমিনারে মূল প্রবন্ধে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য প্রয়াত মওদুদ আহমেদের স্ত্রী হাসনা জসীমউদ্দীন মওদুদ বলেন, ভারত তিস্তা নদী থেকে আরও পানি সরাতে দুটি নতুন খাল খনন এবং একটি উপনদীতে দুটি পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করবে। এতে বাংলাদেশের দুর্ভোগ আরও বাড়বে। তিস্তা নদীর তলদেশ শুকিয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ হুমকির মুখে। পানি বণ্টন চুক্তি সইয়ের জন্য অবিলম্বে ভারতের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে। গবেষণা ও পরামর্শ সেবা প্রতিষ্ঠান চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন খান বলেন, বাংলাদেশ এখন আর নদীমাতৃক রয়েছে কিনা, সেটি বড় প্রশ্ন। ডাইয়িং কারখানার কারণে মেঘনা ও বুড়িগঙ্গা নদী চরমভাবে দূষিত। সুস্থ মস্তিষ্কের কেউ সুন্দরবন ধ্বংস হোক- এমন কোনো প্রকল্প নেবে না, কিন্তু এই সরকার অপরিকল্পিত প্রকল্প নিয়েছে। সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, পদ্মা সেতুর নিচে তাকালে শুধু বালুচর দেখা যায়। ৮ থেকে ১০ বছর পরে নদীতে পানিপ্রবাহ থাকবে কিনা, সেটি প্রশ্ন। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে চলাচলকারী তেল ও কয়লাবাহী জাহাজ ডুবে যাওয়ার ঘটনা এখনও ঘটছে। সেমিনারের শুরুতে কোরআন তেলাওয়াত করেন ওলামা দলের আহŸায়ক মাওলানা নেছারুল হক। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পরিবেশবীদ হাসনা জসীমউদ্দীন মওদুদ। বিএনপির জলবায়ু বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল ও সহ-জলবায়ু বিষয়ক সম্পাদক কাজী রওনকুল ইসলাম টিপুর সঞ্চালনায় সেমিনারে বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন আহমেদ প্রমুখ। আরও বক্তব্য দেন- বিএনপির মিডিয়া সেলের আহŸায়ক জহির উদ্দিন স্বপন, দলের যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন প্রমুখ।