এফএনএস : জ¦ালানি তেল ও ভোজ্য তেলের সঙ্গে পালা দিয়ে বাড়ছে বাজারে চালের দাম। এক সপ্তাহ ব্যবধানে সব ধরনের চালের দাম বাড়ছে ২ থেকে ৩ টাকা করে। পাইকারি বাজারে নাজিরশাইল গত সপ্তাহে ৫৮ থেকে ৬৫ টাকা থাকলেও তা এক সপ্তাহে বেড়ে ৬০ থেকে ৬৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। মিনিকেট ৬৪ টাকা, যা ছিল ৬২ টাকা। আটাশ চাল ৪৮ টাকা, গত সপ্তাহে যার দাম ছিল ৪৪ টাকা। পাইকারি বাজার থেকে ৫০০ গজ দূরের খুচরো বাজারে এসব চাল বিক্রি হয় ৪ থেকে ৮ টাকা বেশি কেজিতে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বর্তমানে চালের বেড়েছে ৮ শতাংশ। সর্বাধিক বেড়েছে মিনিকেট ও নাজিরশাইল চালের দাম। এদিকে দেশে ২০ লাখ মেট্রিক টন রেকর্ড পরিমাণ মজুদ থাকার পরও চালের দাম বেড়েই চলছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সারাদেশে চাহিদার তুলনায় যত্রতত্র গড়ে উঠেছে চালের মিল। যারা ইচ্ছেমতো মজুদ করে বাড়িয়ে দিচ্ছেন দাম। দাম বৃদ্ধির পেছনে হাত রয়েছে শিল্পপতিদের সিন্ডিকেটেরও। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমানে দেশের বেশির ভাগ ভোক্তা চিকন ও মাঝারি মানের চাল খায়। এই চাল উৎপাদন হয় বোরো মৌসুমে। গত বোরো মৌসুমের ধান-চালের মজুদ প্রায় শেষ। ফলে সরবরাহ কম। আবার জ¦ালানি তেলের দাম বাড়ানোয় পরিবহন খরচ বেড়েছে। বাড়তি এই পরিবহন খরচ চালের দামে প্রভাব ফেলেছে। বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, মিলগেট থেকে পাইকারি বাজার পর্যন্ত পরিবহন খরচ কেজিতে এক টাকা ২০ পয়সা থেকে এক টাকা ৪০ পয়সা। মিলগেট থেকে ঢাকার পাইকারি বাজারে লাভসহ কেজিতে দাম বাড়ে দুই টাকা ৪০ পয়সা। রাজধানীর পাইকারি বাজার থেকে খুচরা বাজার পর্যন্ত পরিবহন খরচ হয় বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ১০ থেকে ১২ টাকা। আর রাজধানীর আশপাশের উপজেলায় নিতে বস্তাপ্রতি খরচ হয় ১৮ থেকে ২০ টাকা। লেবার খরচ হয় প্রতি কেজিতে ৩০ থেকে ৪০ পয়সা। এত মজুদের পরও চালের দাম না কমার কারণ নিয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, চালের দাম বাড়ার পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে। মিলাররা সরকারি গুদামে চাল দিলেও খোলাবাজারে সঠিকভাবে সরবরাহ করছে না। ইচ্ছামতো সরবরাহ করে বাজারে দাম বাড়াচ্ছে। আবার এক শ্রেণির ব্যবসায়ী চাচ্ছেন দেশে চাল আমদানি হোক। এর জন্য দাম বাড়িয়ে বাজারে চাপ তৈরি করছেন। তৃতীয়ত, বড় মিলাররা, বিশেষ করে করপোরেট কোম্পানিগুলো চালের বাজার ও ছোট ছোট মিল নিয়ন্ত্রণ করছে। এদিকে পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও চালের দাম না কমা প্রসঙ্গে স¤প্রতি ক্ষোভ জানিয়েছেন খোদ খাদ্যমন্ত্রীও। স¤প্রতি খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, যখন স্টক ২০ লাখ ৭০৮ মেট্রিক টন, তখন চালের দাম বাড়ছে। হাউ ইজ ফানি! খাদ্যমন্ত্রী বলেন, দেশের বাজারে মোটা চালের দাম বাড়েনি। কয়েক সপ্তাহ ধরে দাম কমতির দিকে। মোটা চালের অধিকাংশ নন-হিউম্যান কনজামশনে চলে যাওয়ায় এবং মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের কারণে সরু চালের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে। এ কারণে সরু চালের দাম কিছুটা বেড়েছে। তিনি সরু ধানের উৎপাদন বাড়াতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণে কৃষিমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। অন্যদিকে কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক বলেন, কৃষি উৎপাদন বাড়াতে ইতোমধ্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছে। নতুন উদ্ভাবিত দুটি জাত ব্রি-৮৯ ও ব্রি-৯২ বোরো ধানের উৎপাদন স¤প্রসারণ করা হচ্ছে। এই প্রজাতির উৎপাদন বেশি হবে এবং চালও সরু হবে। এ ছাড়া খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে উচ্চ ফলনশীল ধানের চাষ বাড়ানো হচ্ছে। এদিকে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারকে দুটি পরামর্শ দিচ্ছেন বাজার বিশ্লেষকরা। তাঁরা বলছেন, খোলাবাজারে চালের বিক্রি বাড়াতে হবে। সঙ্গে পরিমাণও। এ ছাড়া বাজার ব্যবস্থাপনা কঠোর করতে হবে। মিল থেকে খুচরা বাজার পর্যন্ত চাল সরবরাহ ব্যবস্থায় কঠোর নজরদারি করতে হবে, বর্তমানে যা খুবই দুর্বল। এদিকে জানা গেছে, বাজারে ভরপুর সরবরাহের পাশাপাশি অতিমূল্যে চাল বিক্রি হলেও দেশের কৃষকরা খুব বেশি সুবিধা পাচ্ছেন না। কৃষকরা বলছেন, ধান বিক্রি করে তাদের খরচ ওঠে কোনোমতে। এদিকে আড়ৎদারদের দাবি, সারাদেশে যত্রতত্র গড়ে উঠেছে চালকল, এগুলোর মালিকরা অতি মুনাফার লোভে দাম বাড়াচ্ছেন। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে যত মিল আছে, তার অর্ধেক মিল হলেই চলত। মিল বেশি হওয়ায় সবার কাছে ধান-চাল স্টক আছে। এ ছাড়া মাল কিনে স্টক করে কৃত্তিম সংকট দেখিয়ে চালের দামটা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। তার কারণে চালের দাম বেশি। আর মিল মালিকরা বলছেন, কৃষককে সঠিক মূল্য দেয়া, আবার বাজারে ভোক্তাকে কম দামে চাল খাওয়ানোÑ দুটি একসঙ্গে সম্ভব না। কৃষকরা যেন ভালো থাকে, আগামীতে তারা যেন ধান থেকে বিমুখ না হয়, কৃষকরা যেন ধানের ন্যায্যমূল্য পায়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা উচিত। ভোক্তা অধিকার সংস্থা কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) দাবি, শুল্ক ছাড় দিয়ে চাল আমদানির পাশাপাশি সব পর্যায়ে কঠোর মনিটরিং জারি রাখা গেলেই দাম কমানো সম্ভব। সংস্থাটির সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, বাজার তদারকিটা হওয়া উচিত কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে। যদি এটা ঠিকভাবে ডিস্ট্রিবিউশন না হয়, কৃত্তিম সংকটের আশঙ্কা থাকে। আজকে যে বাজারে হু হু করে দাম বাড়ছে, এসবগুলো তারই প্রতিফলন। খাদ্য অধিদপ্তরের সরবরাহ, বণ্টন ও বিপণন বিভাগের পরিচালক মো. আনিসুজ্জামান বলেন, আমাদের চাহিদার তুলনায় বেশি ধান উৎপন্ন হয়। আমরা প্রান্তিক কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনি। সেটা থেকে চাল করে বাজারে ছাড়ি। নিয়মিত মনিটরিং করার পরও পাইকারি বাজারে চালের দাম কমছে না। তিনি বলেন, চালের দাম বাড়ানোর বিষয়ে মিলমালিকরা দোষ দেন মিলমালিকদের। আর মিলমালিকরা দোষ দেন পাইকারী ব্যবসায়ীদের। মাঝখানে সাধারণ মানুষের অবস্থা খারাপ।