এফএনএস: বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বাতাসের শহরগুলোর মধ্যে রাজধানী ঢাকা একটি। ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ঢাকার বায়ুমান সূচক নিয়ে গবেষণা করেছে স্ট্যামফোর্ড বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, গত ছয় বছরের মধ্যে ঢাকার মানুষ মাত্র ৩৮ দিন ভালো বাতাস পেয়েছে। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে গড় বায়ুদূষণের পরিমাণ বেড়েছে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। ফলে চীনের উহান ও ভারতের নয়াদিলিকে পেছনে ফেলে ঢাকা বিশ্বে প্রথম হয়। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, আহসান মঞ্জিল, আবদুলাহপুর, মতিঝিল, ধানমন্ডি-৩২, সংসদ ভবন, আগারগাঁও, মিরপুর-১০ এবং গুলশান-২ এই এলাকাগুলোতে দূষণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, রাত ১০টার পর উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গ থেকে প্রচুর মালবাহী ট্রাক ঢাকা শহরে প্রবেশ করে, যে কারণে এসব যানবাহন থেকে রাতে প্রচুর বায়ুদূষণ হয়। এ ছাড়া রাতে সড়কে সিটি করপোরেশনের ঝাড়ু দেওয়ায় বাতাসে ধুলাবালি উড়তে থাকে। অন্যদিকে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের গবেষণা বলছে, সীমান্তের বাইরে থেকে ক্ষতিকর বিভিন্ন বস্তুকণা বাতাসে ভেসে বাংলাদেশে উড়ে আসার কারণে ঢাকার বায়ু আরো বেশি দূষিত হয়ে পড়ছে। গবেষকরা বলছেন, রাজধানীর বায়ুদূষণের জন্যে প্রায় ৩০ ভাগ দায়ী ভারত ও মিয়ানমারের মতো প্রতিবেশি দেশ থেকে আসা এসব অতি সূ² পদার্থ। এসব পদার্থের মধ্যে রয়েছে অ্যামোনিয়া, নাইট্রিক অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, সীসা, কার্বন, ভোলাটাইল অর্গানিক কম্পাউন্ড, ওজন গ্যাস ইত্যাদি। ঢাকায় পরিবেশক বিষয়ক একটি গবেষণা সংস্থা এনভায়রনমেন্ট এন্ড সোশাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন বা এসডোর চালানো গবেষণায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১৭ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত তিন বছর ধরে এসব গবেষণা চালানো হয়। সংস্থাটির তথ্যমতে, সীমান্তের বাইরে থেকে আসা এসব অতি সূ² বস্তুকণা ঢাকার পরিবেশ দূষণের জন্য ৩০ ভাগ দায়ী হলেও এগুলো মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর। বাইরে থেকে আসা এই ৩০ ভাগের মধ্যে যেসব দূষণকারী পদার্থ থাকে সেগুলো পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের অনেক ক্ষতি করতে পারে। অর্থাৎ ক্ষতির দিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায় সীমান্তের ওপার থেকে বাতাস যেসব বিষাক্ত পদার্থ বয়ে আনছে সেগুলো স্বাস্থ্যহানির জন্য ৮০ ভাগ দায়ী, বলেন তিনি। এসব বস্তুকণা মানুষ নিশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করছে এবং সে কারণে তাদের স্বাস্থ্য-জনিত নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, কার্বন মনোক্সাইড বুকে ব্যথাসহ শ্বাসতন্ত্রের নানা অসুখের জন্য দায়ী। নিশ্বাসের সঙ্গে এটি গ্রহণ করলে হৃদরোগও হতে পারে। নাইট্রোজেন অক্সাইডের কারণে নানা ধরনের প্রদাহ হয়, সালফার ডাই অক্সাইডের কারণে হতে পারে হাঁপানিসহ হৃদরোগ, ওজন গ্যাস ফুসফুসের কার্যক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং সীসার কারণে শিশু ও বয়স্ক মানুষেরা খুব দ্রুত শ্বাসকষ্ট-জনিত অসুখে এবং শ্রবণ ও স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া এমনকি ক্যান্সারেও আক্রান্ত হতে পারে। তবে বায়ুদূষণের জন্য দায়ী এসব ক্ষতিকর পদার্থ বাংলাদেশে খুব কমই উৎপন্ন হয়। দেশের বাইরে থেকে আসা এসব দূষণকারী পদার্থ নিয়ে করণীয় তেমন কিছু নেই। কিন্তু স্থানীয়ভাবে যে দূষণ সৃষ্টি হচ্ছে তা প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপের কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে বাস্তবায়ন চোখে পড়ে না। পরিবেশবিদরা বলছেন, বাতাসে দূষণ কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। উল্টো তারা অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি-নির্মাণকাজের মাধ্যমে বাতাসে দূষণ বাড়াচ্ছে। এ ছাড়া ইটভাটা ও শিল্পকারখানা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া রোধে তেমন কার্যকর পদক্ষেপ নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের। এই অভিযোগ স্বীকার করেছেন ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস ও ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম। তারা জানিয়েছেন, এ সমস্যা থেকে উত্তরণে কাজ করছেন। কিন্তু ঢাকা বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় প্রথম সারিতে কেন এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি সংস্থা দুটি। এর আগে ২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তর (ডিওই), ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশন ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআরটিএ) ৯ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। এর মধ্যে ছিল বর্জ্য বহনকারী যানবাহন, নির্মাণসামগ্রী ও নির্মাণ কাজের স্থানগুলো ঢেকে রাখার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। এ ছাড়া বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে ঢাকার রাস্তায় পানি ছিটানো। দেখা গেছে, ডিএনসিসির কারওয়ানবাজার, তেজগাঁও, মহাখালী, বনানী, মোহাম্মদপুর, মিরপুর ও ডিএসসিসির মতিঝিল, ফকিরাপুল, যাত্রাবাড়ি, জুরাইনসহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। কোথাও নির্মাণসামগ্রী ও কাজের স্থান ঢেকে রাখা হয়নি। অনেক এলাকায় খোলা ট্রাকে বর্জ্য পরিবহন করছে। ডিএসসিসির তুলনায় ডিএনসিসির প্রধান সড়কে বেশি পানি ছিটাতে দেখা গেছে। ডিএনসিসির পরিবহন সূত্র জানায়, নগরের প্রধান সড়কগুলোতে পানি ছিটাতে ১০টি কনটেইনারবাহী ট্রাক রয়েছে। এসব ট্রাক দিয়ে নগরের প্রধান সড়কে পানি ছিটানো হচ্ছে। এ ছাড়া সড়ক থেকে ধুলাবালি স্বয়ংক্রিয়ভাবে তুলে নিতে দুটি যন্ত্র রয়েছে। অন্যদিকে ডিএসসিসি জানায়, তারাও সড়কে পানি ছিটায়। কিন্তু কয়টি গাড়িতে, কয় লিটার পানি ছিটানো হয় তা সঠিকভাবে জানাতে পারেনি সংস্থাটি। তবে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, বাতাস দূষণের অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি সড়ক ঝাড়ু দেওয়া। এর বাইরে সড়কে অপরিকল্পিত খোঁড়াখুঁড়ি, রাস্তায় নির্মাণসামগ্রী রাখা বন্ধ, জলাধার সংরক্ষণসহ বেশকিছু কাজ করছে ডিএনসিসি। এসব কাজ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে। আশা করি সামনের বছরগুলোতে ঢাকার বাতাসে দূষণের পরিমাণ কমে আসবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রমতে, সারা দেশে ১ লাখ ৫৩ হাজার মানুষ মারা যান বায়দূষণ থেকে অসুস্থতাজনিত রোগে। এছাড়া বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর শুধু ঢাকাতেই ১০ হাজারের বেশি মানুষ মারা যান। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই দূষণ বন্ধে সিটি করপোরেশন এবং পরিবেশ অধিদপ্তরকে আরও বেশি তদারকি করতে হবে।