এফএনএস : আজ ৭ মার্চ। বছর ঘুরে সাতই মার্চ এলেই মনে পড়ে ইতিহাসের মহামানব জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা। কীভাবে দীর্ঘ সংগ্রামের রক্তাক্ত পথ পেরিয়ে ধাপে ধাপে তিনি একত্রিত করেছিলেন সমগ্র জাতিকে। ১৯৭১-এর সাতই মার্চ, এমন একটি দিনের জন্যই বঙ্গবন্ধু নিজকে, আওয়ামী লীগকে সুদীর্ঘ ২৩টি বছর ধরে প্রস্তুত করেছিলেন এবং বাঙালী জাতিকে উন্নীত করেছিলেন স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে। ১৯৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়যুক্ত হয়ে প্রমাণ করেছিলেন বাঙালী জাতির তিনিই একমাত্র বৈধ রাজনৈতিক প্রতিনিধি। দলের সামান্য একজন কর্মী হিসেবে আমার ঠাঁই হয়েছিল তাঁর নৈকট্য লাভের। খুব কাছ থেকে এ মহান মানুষটিকে যতোটা দেখেছি তাতে কেবলই মনে হয় আমরা যারা রাজনীতি করি, তাদের কত কিছু শেখার আছে বঙ্গবন্ধুর জীবন থেকে। সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে আওয়ামী লীগ দলটিকে গড়ে তুলেছিলেন নিজ পরিবারের মতো। শ্রেণী নির্বিশেষে দলীয় প্রতিটি নেতা-কর্মীকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন। সকলের প্রতি ছিল তাঁর প্রগাঢ় আস্থা, ছিল অকুণ্ঠ ভালবাসা। আর এজন্য সকলেই তাঁর প্রতি স্থাপন করেছিল গভীর বিশ্বাস। বিশেষ করে দলের কর্মীদের তিনি আপন সন্তানের মতো ভালবাসতেন। তাদের দুঃখ-কষ্টে, বিপদ-আপদে সহমর্মী হতেন। শুধু তাই নয় এমনকি বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের পর্যন্ত বিশেষভাবে সম্মান প্রদর্শন করতেন। কখনও কারও মনে আঘাত দিয়ে কোন কথা বলতেন না। অহঙ্কার আর দাম্ভিকতা ছিল তাঁর স্বভাব বিরুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল সময়ের চাহিদা অনুযায়ী নিজস্ব অবস্থান কোথায় হওয়া উচিত সেটি যেমন বুঝতেন, তেমনিভাবে কে কোথায় যোগ্যতর আসনে অধিষ্ঠিত হবেন তাঁকে সে জায়গাটিতে বসিয়ে দিতে ভুল করতেন না মোটেই। তাইত ১৯৭১-এ তাঁর অনুপস্থিতিতে মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদানের গুরুভার অর্পণ করেছিলেন জাতীয় চার নেতাকে এবং তাঁরা সে দায়িত্ব সফলভাবে সম্পন্নও করেছিলেন। খুব কাছ থেকে দেখেছি অসহযোগ আন্দোলনের সময় ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনাকালে সবসময় পাশে রাখতেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমেদকে। সকলকে সম্মানিত করতেন বলেই বাংলার সর্বস্তরের মানুষের ভালবাসায় সিক্ত হয়ে “বঙ্গবন্ধু” উপাধি পেয়েছেন এবং হয়েছেন “জাতির জনক।” বাংলার মানুষের মনের মণিকোঠায় যেমন স্থান পেয়েছেন, তেমনি জনগণও তাঁর চেতনায় ছিল দেদীপ্যমান। টুঙ্গীপাড়ার নিভৃত পলীতে পিতা-মাতার পাশেই শায়িত বঙ্গবন্ধুকেই আজ তাই নানাকারণে বেশি মনে পড়েÑ চেতনায় সততই বিরাজ করে। মনে পড়ে তাঁর বজ্রকণ্ঠে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য অগ্নিঝরা সাতই মার্চের ঐতিহাসিক নির্দেশাবলি ও তৎপরবর্তী অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলোর কথা। রাজনৈতিক অধিকার অর্জনের রক্তঝরা পথে আÍত্যাগের অপার মহিমায় ভাস্বর সাতই মার্চ দিনটি জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সুউচ্চ ধাপ। সেজন্যই এদিনে প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষণটি আমাদের জাতীয় ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। ১৯৭১-এর সাতই মার্চের বসন্তে জাতির হৃদয় জাতীয় মুক্তির আকাক্সক্ষায় উদ্বেলিত হয়েছিল, উত্তাল হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ডাকে। অগ্নিঝরা উত্তাল মার্চে অসহযোগ আন্দোলনের ঊর্মিমুখর দিনগুলো আজও চোখে ভাসে। বাঙালী জাতি ও অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একইসঙ্গে স্বাধীনতার মন্ত্রে এক সুতোয় বাঁধা পড়ার দিন সাতই মার্চ। সেদিন তাঁর অঙ্গুলি হেলনে কার্যত পাকিস্তানের পতন ঘটেছিল। তাঁর বজ্রকণ্ঠে সেদিন ফুঁসে উঠেছিল পদ্মা-মেঘনা-যমুনা। যে বজ্রকণ্ঠের উচ্চ নিনাদে নগর-বন্দর থেকে গ্রামের মেঠো পথে মানুষের হৃদয় জাতীয় মুক্তির নেশায় জেগে উঠেছিল। রেসকোর্স ময়দানের (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) মঞ্চ ঘিরে সেদিন সকাল থেকেই বিক্ষুব্ধ বাংলার সংগ্রামী জনতা এক স্রোতে এসে মিশেছিল। সেকি উন্মাদনা! সে এক অভূতপূর্ব গণজাগরণ! কী উত্তেজনাময় দিনই না ছিল জাতির জীবনে। এক কঠিন সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাঙালীর প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার স্বপ্ন সামনে রেখে কী বলবেন তার জনগণকে? এই প্রশ্নটিই ছিল সবার কৌতূহলী মনে। একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও আদর্শ সামনে নিয়ে যারা সংগ্রাম করেÑ শত অত্যাচার-নির্যাতনের দুঃসহ যন্ত্রণা তাদের গতিপথকে রোধ করতে পারে না। তাই কারাগারের অন্ধকার নিঃসঙ্গ মুহূর্তেও নয়, কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানী শাসকদের কাছে মাথানত করেননি। কোন কিছুই তাঁকে তাঁর অঙ্গীকার আর লক্ষ্য থেকে সরাতে পারেনি। আজকাল অবাক হয়ে লক্ষ্য করি ইতিহাস বিকৃতির ধারায় অনেকেই মননের দীনতা ও নীচতা প্রকাশ করেন বিভিন্ন মিডিয়ায়। তারা ইতিহাসের অমোঘ সত্যকে এড়িয়ে নিজকে বড় করে দেখান। স্বাধীনতা সংগ্রামের রক্তঝরা প্রতিটি দিনের কর্মসূচী নির্ধারণ হতো বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলনÑ ইতিহাসের পরতে পরতে স্থান পাওয়া প্রতিটি অর্জনই অর্জিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। তখন বাঙালী জাতি বঙ্গবন্ধুকে সামনে নিয়েই পথ হেঁটেছে। আমরা সেদিন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে শুধু কর্মীর দায়িত্ব পালন করেছি মাত্র। ইতিহাস বিকৃতির আস্ফালন দেখি আর ভাবি-আদর্শচ্যুত হলে মানুষ বোধহয় এভাবেই মিথ্যার মোড়কে সত্যকে গোপন করতে চায়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালী জাতি বিজয় অর্জন করেছিল। যারা আজ ইতিহাস বিকৃত করছে, তাদের জন্য ইতিহাস কাঠগড়া নির্ধারণ করে রেখেছে। আজ সাতই মার্চের সেই দিনটির কথা ভাবলে বিস্ময় মানি! বঙ্গবন্ধু সেদিন নিরস্ত্র বাঙালী জাতিকে সশস্ত্র বীরের জাতিতে পরিণত করেন। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে ছুটে আসা ১০ লাখেরও বেশি জনতা ছিল যেন প্রতিটি ঘরে ঘরে স্বাধীনতার বার্তা পৌঁছে দেয়ার একেকজন দূত। স্বাধীনতার ডাক দিয়ে বঙ্গবন্ধু ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার উন্মাদনা ছড়িয়েছিলেন। সেই উন্মাদনা গোটা জাতির রক্তে ছড়িয়েছিল। নেতা জানতেন তার মানুষের ভাষা। জনগণ বুঝত নেতার ইশারা। নেতার কণ্ঠের মাধুর্য তাদের জানা ছিল। তাই জাতি সেদিনই নেতার ডাক পেয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। আর সেদিনের রেসকোর্স ময়দান যেন আবহমান বাংলার বাসন্তী সূর্য আর উদার আকাশকে সাক্ষী রেখে নির্ভীক নেতা এবং বীর বাঙালীর কণ্ঠে একই সুরে ধ্বনিত হয়ে ওঠে যুগ-যুগান্তর, দেশ-দেশান্তরের সকল মুক্তি পিপাসু সভ্য জাতির অমোঘ মন্ত্র “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” দিগন্ত কাঁপিয়ে নিযুত কণ্ঠে ধ্বনি ওঠে “জয় বাংলা।” সাতই মার্চ তাই বাংলাদেশের সার্বিক মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে দুর্গম প্রস্তর পথের প্রান্তে অতুলনীয় স্মৃতি ফলক। সেদিন ছিল রোববার। সকাল থেকেই বঙ্গবন্ধুর বাসভবনটি আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ও স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ছাত্রনেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে সরগরম। পূর্ব ঘোষিত সময় অনুযায়ী বেলা ২টায় সভা শুরু হওয়ার কথা। জ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দসহ আমাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করে বঙ্গবন্ধু জনসভার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। রাজ্জাক ভাই, সিটি আওয়ামী লীগের সভাপতি গাজী গোলাম মোস্তফা, মণি ভাই, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আবদুর রউফ, সাবেক সাধারণ সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ আলী, নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দুস মাখন, সিরাজুল আলম খানসহ আমরা একটি গাড়িতে রওনা করি। নিরাপত্তার জন্য রাজ্জাক ভাই ও গাজী গোলাম মোস্তফা ড্রাইভারকে ৩২ নম্বর সড়কের পশ্চিম দিক দিয়ে যেতে বলেন। রেসকোর্স ময়দানে সেদিন মুক্তিকামী মানুষের ঢল নেমেছিল। আকারের বিশালত্ব, অভিনবত্বের অনন্য মহিমা, আর সংগ্রামী চেতনার অতুল বৈভবে এই গণমহাসমুদ্র ছিল নজিরবিহীন। চারদিকে লাখ মানুষের গগনবিদারী কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে “জয় বাংলা” শ্লোগান। কার্যত ১৯৬৯ থেকেই “জয় বাংলা” শ্লোগানটি ছিল বাঙালীর রণধ্বনি। বীর বাঙালীর হাতে বাঁশের লাঠি এবং কণ্ঠে জয় বাংলা শ্লোগান যেন প্রলয় রাতের বিদ্রোহী বঙ্গোপসাগরের সঘন গর্জন। রেসকোর্স ময়দানে প্রাণের টানে বাংলার মানুষ বার বার ছুটে আসে। এর আগেও এসেছিল ১৯৬৯-এর ২৩ ফেব্র“য়ারি। সেদিন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসির মঞ্চ উপেক্ষা করে, বাঙালীর মুক্তির জয়গান গেয়ে ৩৩ মাস কারাবন্দী থেকে এক অপূর্ব ধৈর্য ও নির্লিপ্ততার মধ্যে দিয়ে বঙ্গবন্ধু স্বৈরশাসক আয়ুব খানের মোকাবেলা করেন। বাঙালী জাতি সেদিন তাঁর মুক্তির জন্য রাজপথে শ্লোগান তুলেছিল, “শপথ নিলাম শপথ নিলাম, মুজিব তোমায় মুক্ত করবো; শপথ নিলাম শপথ নিলাম, মা-গো তোমায় মুক্ত করবো।” এবং তাঁকে মুক্ত করে মুক্তমানব শেখ মুজিবকে বাঙালী জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে “বঙ্গবন্ধু” উপাধিতে ভূষিত করেছিল। এই সেই রেসকোর্স ময়দান যেখানে বাংলার মানুষ শুনেছে “এক ইউনিট” আর “প্যারিটি”র মৃত্যুঘণ্টা, ’৭০-এর ৭ জুনে শুনেছে ৬ দফার জয় নিনাদ, আর ‘৭১-এর ৩ জানুয়ারি শুনেছে ৬ দফা ও ১১ দফা বাস্তবায়নে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অগ্নিশপথ। আর সাতই মার্চের রেসকোর্স বাংলার মানুষকে শুনিয়েছে স্বাধীনতার অমোঘ মন্ত্র। সাতই মার্চ সকাল থেকেই সারাদেশের জনস্রোত এসে মিলিত হতে থাকে রেসকোর্স ময়দানে। রেসকোর্স ময়দান যেন বিক্ষুব্ধ বাংলার চিত্র। সেদিন প্রিয় নেতা হৃদয় আর চেতনা থেকে যে ডাক দিয়েছেন তা সমগ্র জাতি সানন্দে গ্রহণ করেছে। সকাল থেকেই কী এক উত্তেজনায় টালমাটাল দেশ! কী বলবেন আজ বঙ্গবন্ধু? এই প্রশ্ন নিয়ে লাখ লাখ জনতার মিছিল ছুটে আসে রেসকোর্স ময়দানের দিকে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমরা সভামঞ্চে এলাম ৩টা ১৫ মিনিটে। দীর্ঘ ২৩ বছরের শত সংগ্রাম শেষে দৃঢ়তার সঙ্গে আপোসহীন অবয়ব নিয়ে নেতা এসে দাঁড়ালেন জনতার মঞ্চে। জনতার হৃদয়ে যেন আকাশ স্পর্শ করার আনন্দ দোলা দিয়ে গেল। কিন্তু ঊর্মিমুখর জনতার মধ্যে অধৈর্যের কোন লক্ষণ দেখিনি। নির্দিষ্ট সময়ের বহু আগেই অর্থাৎ সকাল থেকে জনতার স্রোত এসে মিলিত হতে থাকে রেসকোর্স ময়দানে। জনস্রোতে কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায় সভাস্থল। মানুষ গাছের ওপরে উঠে বসে নেতার বক্তৃতা শোনার জন্য। সেদিনের সেই গণমহাসমুদ্রে আগত মানুষের বয়স, পেশা, সামাজিক মর্যাদা, পোশাক-পরিচ্ছদ ও শ্রেণীগত অবস্থানের যতই ফারাক থাকুক না কেন, সে জনতার মধ্যে আশ্চর্য যে সুশৃ´খল ঐকতান ছিল তা হচ্ছে, হাতে বাঁশের লাঠি, কণ্ঠের শ্লোগান আর অন্তরের অন্তরতম কোণে লালিত জাতীয় মুক্তির স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবির পর কালো মুজিব কোট পরিহিত বঙ্গবন্ধু যখন মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন, বাংলার বীর জনতা বজ্রনির্ঘোষে তুমুল করতালি ও শ্লোগানের মধ্যে তাঁকে বীরোচিত অভিনন্দন জ্ঞাপন করে। তাঁর চোখে-মুখে তখন সাড়ে সাত কোটি মুক্তিকামী মানুষের সুযোগ্য সর্বাধিনায়কের দুর্লভ তেজোদৃপ্ত কাঠিন্য আর সংগ্রামী শপথের দীপ্তির মিথস্ক্রিয়ায় জ্যোতির্ময় অভিব্যক্তি খেলা করতে থাকে। আমরা হিমালয়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তন্ময় হয়ে শুনে যাচ্ছি তার সেই দুনিয়া কাঁপানো ভাষণ। যে ভাষণকে বিশেষজ্ঞগণ তুলনা করেন আব্রাহাম লিংকনের ‘গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস’-এর সঙ্গে। অমন সাজানো-গোছানো নির্ভুল ছন্দোবদ্ধ, প্রাঞ্জল, উদ্দীপনাময় ভাষণটি তিনি রাখলেন। কী আস্থা তাঁর প্রিয় স্বদেশের মানুষের প্রতি, প্রধানমন্ত্রিত্ব এমনকি জীবনের চেয়েও কত বেশি প্রিয় তার মাতৃভূমির স্বাধীনতা তাই তিনি শোনালেন। এতটাই বিচক্ষণ ও দূরদর্শী ছিলেন যে, ভাষণে তিনি একদিকে স্বাধীনতার ডাক দিলেন, অন্যদিকে শাসকের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে চিহ্নিত করার পাতানো ফাঁদেও পা দিলেন না। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ যেমন বললেন; তেমনি চার শর্তের জালে ফেললেন শাসকের ষড়যন্ত্রের দাবার ঘুঁটি। বললেনÑ সামরিক শাসন প্রত্যাহার করতে হবে; সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে; নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে; গণহত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে। রক্তের দাগ না মোছা পর্যন্ত অধিবেশনে যোগ না দেয়ার কথাটিও বললেন। ক্যান্টনমেন্টে তখন গুলিবর্ষণ বোমা হামলার প্রস্তুতি। কিন্তু নেতার বিচক্ষণতায় রক্তপাত এড়ানো সম্ভব হলো। সাতই মার্চের ভাষণ নয়, যেন মহানায়কের বাঁশিতে উঠে আসা স্বাধীনতার সুর। সেই সুরে বীর বাঙালীর মনই শুধু নয়, রক্তেও সশস্ত্র স্বাধীনতার নেশা ধরিয়ে দিল। ভাষণটি বঙ্গবন্ধু নিজ সিদ্ধান্তেই দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের সহযাত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জানিয়েছিলেন, ৬ মার্চ সারারাত বঙ্গবন্ধু বিচলিত-অস্থির ছিলেন, তিনি কী বলবেন তার জনগণকে তা নিয়ে। বেগম মুজিব বলেছিলেন, ‘তুমি যা বিশ্বাস কর তাই বলবে।’ সেই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনও শিহরিত হই। এখনও কানে বাজে নেতা বলছেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্র“র মোকাবেলা করবে। আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, বাংলার মানুষের অধিকার চাই।’ সেদিন রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মানুষের মহাসমাবেশ ঘটেছিল সার্বিক জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের পরবর্তী কর্মসূচী সম্পর্কে পথ-নির্দেশ লাভের জন্য। আমরা যারা সেদিনের সেই জনসভার সংগঠক ছিলাম, যারা আমরা মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর পদতলের পাশে বসে ময়দানে উপস্থিত পুরনারী, অশীতিপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, কচি-কিশোর, তরুণ-যুবক, কৃষক-শ্রমিক জনতার চোখে-মুখে প্রতিবাদের-প্রতিরোধের যে অগ্নিশিখা দেখেছি তা’ আজও স্মৃতিপটে ভাস্বর হয়ে আছে। কিন্তু তারা ছিল শান্ত-সংযতÑ নেতার পরবর্তী নির্দেশ শোনার প্রতীক্ষায় তারা ছিল ব্যাগ্র-ব্যাকুল এবং মন্ত্রমুগ্ধ। কী উত্তেজনাময়, আবেগঘন মুহূর্ত ছিল সেদিন। বঙ্গবন্ধু যখন বক্তৃতা শুরু করলেন জনসমুদ্র যেন প্রশান্ত এক গাম্ভীর্য নিয়ে পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে ডুবে গেল। এত কোলাহল, এতো মুহুর্মুহু গর্জন নিমেষেই উধাও। আবার পরক্ষণেই সেই জনতাই সংগ্রামী শপথ ঘোষণায় উদ্বেলিত হয়েছে মহাপ্রলয়ের উত্তাল জলধির মতো, যেন ‘জনসমুদ্রে নেমেছে জোয়ার।’ তাইতো জোয়ার-ভাটার দেশ এই বাংলাদেশ, আশ্চর্য বাঙালীর মন ও মানস। সাতই মার্চের রেসকোর্সে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষকে সম্বোধন করেছেন, “ভাইযেরা আমার” বলে। সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর নির্যাতিত-মুমূর্ষু-বিক্ষুব্ধ চেতনাকে নিজ কণ্ঠে ধারণ করে নির্দেশ দিয়েছেন, “…প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্র“র মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।” ১১০৮টি শব্দ সম্বলিত প্রায় ১৯ মিনিটের এই বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু যে নির্দেশ প্রদান করেছিলেন বাঙালী জাতি তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল। বঙ্গবন্ধু যখন জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের রূপরেখা আর নিজের চরম ত্যাগের কথা ঘোষণা করছিলেন তখন তাঁর কণ্ঠ কাঁপেনি, থামেনি জনশক্তির বলে বলিয়ান গণনায়কের কণ্ঠ বজ্রের হুঙ্কারের মতোই গর্জে উঠেছিল। ইতিহাসের আশীর্বাদস্বরূপ নেতা আর জনতার শিরোপরি যেন বসন্তের আকাশ হতে বিদায়ী সূর্যের আলোকরশ্মি ঝরে পড়ছিল। ঐতিহাসিক সেই দুর্লভ ক্ষণটিতে আমার পরম সৌভাগ্য হয়েছিল নেতার পদপ্রান্তে বসে-সাড়ে সাত কোটি বঞ্চিত-অবহেলিত-নিরন্ন নরনারীর অবিসংবাদিত নেতার দুর্জয় সঙ্কল্পবদ্ধ অপরূপ রূপ প্রত্যক্ষ করার। সর্বাÍক মুক্তিসংগ্রামের অগ্নিশপথে ভাস্বর, যেকোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত সভাস্থলের প্রতিটি নিরস্ত্র মানুষ যেন সেদিন সশস্ত্র হয়ে ওঠে; তাদের চোখ-মুখ শত্র“র বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের দৃঢ় শপথ আর আÍত্যাগের অপার মহিমায় আলোকিত হয়। নেতার বক্তৃতার শেষাংশ “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তি সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” হৃদয়ে ধারণ করে সংগ্রামী জনতার দীপ্ত শ্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামে তথা রাজনৈতিক সংগ্রামে আমরা জয়যুক্ত হয়েছি এবং ভৌগোলিক স্বাধীনতা, সংবিধান, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত পেয়েছি। কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে আজও আমরা জয়যুক্ত হতে পারিনি। অদ্যাবধি আমরা সেই সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি বিধায় সাতই মার্চের ভাষণের আবেদন এখনও অটুট, এখনও স্থায়ী জাতির মননে-হৃদয়ে-চেতনায়। সাতই মার্চ অনন্য-অবিস্মরণীয়।