জি এম শাহনেওয়াজ ঢাকা থেকে ॥ লবণাক্ততার ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে চিংড়ি শিল্পে কর্মরত নারী শ্রমিকরা ভূগছেন নানা জটিল রোগে। এর প্রভাবে অনেকের জীবন সঙ্কটাপূর্ণ। দীর্ঘমেয়াদে লবণ পানিতে কাজ করার কারণে বেড়েছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি। জলবায়ু ক্ষতি ও পানির দূষণের কারণে অনেকেই হারাচ্ছেন নারীত্ব। ভাঙছে সংসারও। এ নিয়ে চিংড়ি শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের মুখে ‘রা’ নেই। ভাবখানা এমন, যে যাই মরুক, আমার কাজটি হলেই চলবে। বেসরকারি সংগঠন এনজিও অক্সফ্যাম ইন বাংলাদেশের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত ১ দশকে শ্রম বাজারে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ২ কোটির বেশি। যার ৭৭ শতাংশই গ্রামীণ নারী শ্রমিক। আর এদের স্বাস্থ্য এবং নিজের সম্পর্কে সচেতনা কম থাকায় – একদিকে যেমন শারীরিক অসুস্থতায় জীবনের ঝুঁকি বাড়ছে। অপরদিকে, – মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন নারীরা। অপর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ভূ-গর্ভস্থ পানির লবণাক্ততা উপকূলের আশপাশের বেশির ভাগ অঞ্চলে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বহুগুন বেড়েছে। বেশির ভাগ উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ুতে লবণাক্ততার পরিমাণ ক্লোরাইড গণনানুযায়ী দেখে গেছে, শুকনা মৌসুমে ১০৩-১২, ৪৪৩ এবং বর্ষা মৌসুমে ৩৪ থেকে ১১, ৩৬৬ পর্যন্ত থাকে। সম্প্রতি প্রকাশিত নীতিপত্র তথ্য অনুযায়ী গ্রীম্মমন্ডলীয় জলোচ্ছাস এবং সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে নোনাপানির অনুপ্রবেশের কারণে দীর্ঘসময় ধরে উপকূলীয় কৃষকদের জীবিকা ও নিম্ম আয়ের মানুষের বিপদাপন্নতা তৈরি হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চিংড়ি শিল্প একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। অপ্রচলিত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্যের স্থান প্রথম। এই খাতের মধ্যে চিংড়ির অবদান শতকরা প্রায় ৮৬ ভাগ। দেশে বর্তমানে প্রায় ১ দশমিক ৪০ লাখ হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ হচ্ছে। এক বছরে চিংড়ি আহরণ প্রায় ৫ হাজার টন। এই অর্জনের পেছনে নারী শ্রমিকদের অবদান বেশি। বেসরকারি সংগঠন লিডার্সের নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার মণ্ডল বলেন, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করেন নারী শ্রমিকরা। কিন্তু কর্ম-পরিবেশ স্বাস্থ্যসম্মত না। চার ধরণের পরিবেশগত সমস্যা রয়েছে কাজের ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের। এর মধ্যে বিশ্রাম নেওয়ার মত কোন ছাউনি নেই, রয়েছে শৌচাগারের অভাব, প্রখন রোদ্রের মধ্যে নারী শ্রমিকদের জন্য খবার পানির ব্যবস্থা থাকে অপ্রতুল এবং কিছু চিংড়ি খামারের পানি পঁচে দূগন্ধের কারণে দূষিত পরিবেশে নারী শ্রমিকদের কাজ করতে গিয়ে অনেকের বাড়ছে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি। তিনি বলেন, অভাবে কারণে ছোট ছোট রোগ শরীরে দানা বাঁধলেও তা গোপন করে যান নারী শ্রমিকরা। বলেন, যখন এসব রোগ বড় আকারের ধারণ করে তখন সংসার পর্যন্ত ভেঙে যায় অনেক নারীর। এই এনজিও পরিচালক আরও বলেন, পুরুষের সমানতালে নারীরা কাজ করলেও মজুরি বৈষম্যের বেড়াজাল থেকে শত চেষ্টার পরও বের হতে পারে না। মজুরি বৈষম্যের জন্য একজন নারী শ্রমিক বছরে প্রায় ৩৬ হাজার টাকা কম আয় করেন। ফলে তারা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন, যা নারীর ক্ষমতায়নের পথে একটি বড় অন্তরায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দীর্ঘদিন লবণ পানিতে কাজ করার কারণে চিংড়ি শিল্পে কর্মরত নারী শ্রমিকরা ৬ ধরণের স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়েন। এসব রোগের মধ্যে ডায়রিয়া, আমাশয়, গা-হাত ও পা ফুলে যাওয়ার কারণে বড় ধরণের চর্মরোগে আক্রান্ত হওয়া, মাথা ঘোরা, অসময়ে গর্ভপাত এবং জরায়ু ক্যান্সার অন্যতম। দেশের সব উপকূলীয় জেলায় নানামূখী সমস্যায় ভুক্তভোগী নারী শ্রমিকরা বলে স্বীকার করেন সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সীগঞ্জ গ্রামের চিংড়ি শ্রমিক রেখা রানী মৃধা ও শেফালী বিবি। তারা বলেন, দীর্ঘদিন লবন পানি ব্যবহারের ফলে উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বেশি; যার মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশু। মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ত পানি গ্রহণ ও ব্যবহারের ফলে জরায়ু সংক্রান্ত বিভিন্ন ঝুঁকিতে পড়ছেন নারী শ্রমিকরা বলে জানান তারা। আর বেসরকারি এনজিও স্ক্যানের সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মুকুল বলেন, চিংড়ি শিল্পে জড়িত নারীদের প্রধান সমস্যা কর্মক্ষেত্রে কর্মপরিবেশ না থাকা। ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে। আর শ্রম বৈষম্যতো রয়েছে। তবে, চিকিৎসকরা বলছেন, দীর্ঘদিন কোন নারী জরায়ু সমস্যায় ভূগলে তা থেকে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। ফলে অনেকেই অল্প বয়সেই বাধ্য হয়ে জরায়ু কেটে ফেলেন। এ সুযোগে অনেক পরিবারে স্বামীরা দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করছেন। এক পর্যায়ে প্রথম স্ত্রীর সংসার ভাঙছে। এছাড়া বাংলাদেশের অন্যান্য যে কোন অঞ্চলেরর তুলনায় লবণাক্ত পানির কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে গর্ভবতী নারীদের খিঁচুনি এবং উচ্চ রক্তচাপের হার বেশি।বর্ষাকালের তুলনায় অন্য মৌসুমে লবণাক্ততা বেশি থাকে ফলে খিঁচুনি এবং উচ্চ রক্তচাপের হারও ওই সময়ে বেশি থাকে। এসব সমস্যা নিরসনের জন্য সুশীল সমাজ, এনজিও, স্থানীয় সরকার ও চিংড়ি ঘের মালিকদের একত্রে কাজ করার জন্য সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন বন, পরিবেশ ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার।