খুলনা প্রতিনিধি: খ্রিস্টীয় ৮ম শতকের মাঝামাঝি সময়ে পালগণ উত্তর ও পশ্চিমবঙ্গে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। খুব সম্ভবত পাল রাজবংশের দ্বিতীয় শাসক ধর্মপালের (৭৮১-৮২১ খ্রিঃ) শাসনামলে বর্তমান যশোর জেলার উপর তাদের কর্তৃত্ব কায়েম হয়। রাজা ধর্মপাল তার পিতার নিকট থেকে একটি ক্ষুদ্র রাজ্যের উত্তরাধিকার লাভ করেছিলেন। কিন্তু তার পরাক্রম ও কূটনীতি এবং সেই সাথে ভাগ্যের পরশ তাকে ভারতবর্ষের উত্তরাংশে একট সুবিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করেছিল। তিনিই পাল রাজাগণের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি যিনি ‘পরমেশ্বর’ এবং ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধিতে ভূষিত হন। তিনিও বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী এবং পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। রাজা ধর্মপাল ৭৮১ থেকে ৮২১ খ্রিস্টাব্দ পর্যমত্ম দীর্ঘসময় শাসন করেছিলেন এবং তার শাসনামলে বর্তমান যশোর জেলার উপরও পালদের কর্তৃত্ব বজায় ছিল। ধর্মপালের পর তার পুত্র দেবপাল (৮২১-৮৬১ খ্রিঃ) সিংহাসনে আরোহণ করেন। দেবপালও তার পিতার ন্যায় অত্যমত্ম যোগ্যতাসম্পন্ন রাজা ছিলেন। তিনি তার প্রজ্ঞা ও পরাক্রমের সাহায্যে কেবলমাত্র তার পিতার সাম্রাজ্য টিকিয়েই রাখেননি বরং তার আমলে পাল সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ বিসত্মার সাধিত হয়েছিল। ধর্মপালের ন্যায় দেবপালও দীর্ঘ সময় পর্যমত্ম শাসন করেন এবং যশোর জেলার উপরও তার একচ্ছত্র কর্তৃত্ব বজায় ছিল। তিনিও বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিলেন। বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারে তিনি বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। দেবপালের পর পাল রাজবংশের অন্য রাজাগণ হলেন রাজা প্রথম সুরপাল (৮৬১-৮৬৬ খ্রীঃ)। প্রথম সুরপাল বিগ্রহপাল নামেও পরিচিত ছিল। তার পরবর্তী রাজাগণ হলেন নারায়ণপাল (৮৬৬-৯২০ খ্রিঃ), রাজপাল (৯২০-৯৫২ খ্রিঃ), দ্বিতীয় গোপাল (৯৫২-৯৬৯ খ্রিঃ) এবং দ্বিতীয় বিগ্রহপাল (৯৬৯-৯৯৫ খ্রিঃ)। তারা প্রত্যেকেই ছিলেন দুর্বল শাসক। তাদের শাসনামলে বিদেশী আগ্রাসনের কারণে সুবিশাল পাল সাম্রাজ্য ক্রমশ ছোট হতে থাকে। খ্রিস্টীয় দশম শতকের মাঝামাঝি সময়ে দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গে গন্ধ্ররা একটি প্রতিষ্ঠিত শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তারা পাল রাজাদের কাছ থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিল। এমনকি পাল সাম্রাজ্যের ভিতরেই উত্তর ও পশ্চিমবঙ্গে কামবোজা শাসকগণ নিজেদের স্বাধীন হিসেবে ঘোষণা করে। ফলশ্র“তিতে রাজা প্রথম মহীপালের সিংহাসনে আরোহণের পূর্ব পর্যমত্ম পাল শাসন আংগা এবং মগধ এ সীমিত হয়ে পড়ে। রাজা প্রথম মহীপালের (৯৯৫-১০৪৩ খ্রিঃ) সিংহাসনে আরোহণের সাথে সাথে ক্ষয়িষ্ণু পাল সাম্রাজ্যের সুদিন ফিরে আসতে শুরম্ন করে। তিনি সিংহাসনে আসীন হয়ে দেখতে পান পাল সাম্রাজ্য মূলত দক্ষিণ বিহার পর্যমত্ম সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। তিনি সফলতার সাথে তার শত্র“দের নিধন করেন এবং কামবোজা শাসকদের কাছ থেকে উত্তর রাধা ও উত্তরবঙ্গ পুনরুদ্ধার করেন। প্রথম মহীপাল তার শাসনামলে উত্তর বিহার পর্যমত্ম পাল কর্তৃত্ব বিসত্মার করতে সফল হয়েছিলেন ফলে পাল সাম্রাজ্য পুনঃ প্রতিষ্ঠা করার কৃতিত্ব অবশ্যই তাকে দেয়া যায়। উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, এ সময় যশোর জেলার উপরও পাল কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রাজা প্রথম মহীপালের পরবর্তী উত্তরাধিকারীগণ হলেন ন্যায় পাল (১০৪৩-১০৫৮ খ্রিঃ) এবং তৃতীয় বিগ্রহপাল (১০৫৮-১০৭৪ খ্রিঃ) তাদের শাসনামলে কালাচুরি’র নৃপতি লক্ষীকর্ণ বঙ্গদেশের এ অংশে বারবার অভিযান চালান। লক্ষীকর্ণের নেতৃত্বে সংগঠিত ক্রমাগত বিদেশী আগ্রসন পাল সাম্রাজ্যের ভীত নাড়িয়ে দিয়েছিল। পাল রাজাগণ এসময় কেবলমাত্র পূর্ব, পশ্চিম এবং উত্তরবঙ্গের কর্তৃত্বই হারান নি, বরং মগধের এর উপরও তাদের কর্তৃত্ব ক্রমশ কমে আসতে শুরু করে। তৃতীয় বিগ্রহপালের পুত্র ছিলেন দ্বিতীয় মহীপাল (১০৭৫-১০৮০ খ্রিঃ)। দ্বিতীয় মহীপাল তার শাসনামলের প্রথমদিকে যশোর জেলার উপর কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরবর্তীতে এ অঞ্চল বর্মনদের দখলে চলে যায়। উত্তবঙ্গের কৈর্বত্র বিপ্লবের সুযোগে এ অঞ্চল বর্মনদের দখলে চলে যায় এবং ১০৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গে তারা স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। ৮ খুব সম্ভবত বঙ্গে কালাচুরি কর্ণের আগ্রাসনের সময়ই বর্মনদের আগমন ঘটে। বর্মনরা আগ্রাসনের সময় লক্ষীকর্ণকে সহযোগিতা করে এবং এদেশে থেকে যায়। পরবর্তীতে সুবিধামত সময়ে তারা নিজেদের জন্য একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। এ রাজবংশের প্রসিদ্ধ শাসকগণ হলেন ভজরাবর্মণ, জাতবর্মন, হরিবর্মন, সমলবর্মন এবং ভোজবর্মন। বর্মনরা সনাতন বেদ এর অনুসারী ছিলেন। পরবর্তীতে তারা ‘সেন’ নামক আর একটি ব্রাহ্মণ সনাতন রাজবংশ দ্বারা উৎখাত হন। ৯ রাজা বিজয়সেনের সময় বঙ্গদেশের এ অংশে এবং যশোর জেলার উপর সেন রাজবংশের শাসনের সূত্রপাত হয়। রাজা বিজয়সেন সেন রাজবংশের তৃতীয় রাজা ছিলেন (১০৯৭-১১৬০ খ্রিঃ)। সুবিশাল সেন সাম্রাজ্যের ভিত্তিপ্রসত্মর তার হাতেই রচিত হয়েছিল। তিনি প্রায় সমগ্র বঙ্গদেশ জয় করেছিলেন। তবে বর্মন শাসকদের কাছ থেকে তার পূর্ববঙ্গ(সমতট) বিজয়ের সঠিক সময় সম্পর্কে জানা সম্ভব হয়নি। সম্ভবত তিনি তার শাসনামলের শেষ সময়ে যশোর জেলার উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার উত্তরসূরি বল্লাল সেন (১১৬০-১১৭৮ খ্রিঃ) এবং লক্ষণসেন (১১৭৮-১২০৬ খ্রিঃ) ও এ জেলার উপর তাদের কর্তৃত্ব বজায় রেখেছিলেন। লক্ষণসেনের শাসনামলেই ১২০৪ খ্রিঃ বঙ্গদেশে বিখ্যাত মুসলিম আগ্রাসনের সূত্রপাত ঘটে। শিহাবুদ্দিন মুহাম্মদ ঘুরীর সেনাপতি মালিক ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ-বিন-বখতিয়ার-খিলজী এ সময় বঙ্গদেশ আক্রমন করেন। যখন বখতিয়ার খিলজী তার সেনাবাহিনী নিয়ে লক্ষণসেনের রাজধানী নদীয়ায় পৌঁছেন তখন রাজা লক্ষণসেন তার দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন। মুসলিম সেনাবাহিনীর আগমনের সংবাদ শুনে তিনি নগ্নপদে তার রাজধানী হতে নৌকাযোগে বিক্রমপুরে পালিয়ে যান। ১২০৬ খ্রিঃ তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যমত্ম সময় তিনি সেখানে শাসনকার্য পরিচালনা করেন।