খুলনা প্রতিনিধি ॥ বাগেরহাটের নাম কে করে দিয়েছিলেন তা গবেষণা সাপেক্ষ হলেও আজ তা নিরূপণ করা দুঃসাধ্য। কারো কারো মতে, বাগেরহাটের নিকটবর্তী সুন্দরবন থাকায় এলাকাটিতে বাঘের উপদ্রব ছিল। এ জন্যে নাম হয়তো ‘বাঘেরহাট’ হয়েছিল এবং ক্রমান্বয়ে তা বাগেরহাট-এ রূপান্তরিত হয়েছে। মতান্তরে হজরত খানজাহান (র.)-এর প্রতিষ্ঠিত ‘খলিফাত-ই-আবাদ’-এর বিখ্যাত ‘বাগ’ অর্থ বাগান, এ অঞ্চলে এতই সমৃদ্ধি লাভ করে যে, তা থেকেই হয়ে দাঁড়িয়েছে বাগের আবাদ তথা ‘বাগেরহাট’। তবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মতটি হচ্ছে, শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত ভৈরব নদের উত্তর দিকের হাঁড়িখালী থেকে বর্তমান নাগের বাজার পর্যন্ত যে লম্বা বাঁক অবস্থিত, আগে সে বাঁকের পুরাতন বাজার এলাকায় একটি হাট বসতো। আর এ হাটের নামে এ স্থানটির নাম হলো বাঁকেরহাট। কালক্রমে বাঁকেরহাট পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়িয়েছে বাগেরহাট নামে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের কূল ঘেঁষে বাগেরহাট জেলার অবস্থান। বাগেরহাট খুব পুরনো ভূখণ্ড না হলেও বাগেরহাটের সমৃদ্ধির ইতিহাস উপমহাদেশের বহু প্রাচীন জনপদের সমকালীন ও সমপর্যায়ের। হজরত খানজাহান (র.)-এর সময় এ অঞ্চলের দীঘি খননকালে বিশেষ করে ‘খাঞ্জেলী দীঘি’ খননকালে পাওয়া ধ্যানমগ্ন বুদ্ধমূর্তি থেকে অনুমিত হয় হজরত খানজাহান (র.)-এর আগমনের বহু আগে থেকেই বাগেরহাটে এক বিস্তৃত জনপদ ছিল। বর্তমানে সেই বুদ্ধমূর্তি বাগেরহাটের শিববাড়ী থেকে স্থানান্তরিত হয়ে ঢাকার কমলাপুর বৌদ্ধবিহারে রক্ষিত আছে। বাংলার শাসক যখন নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ (১৪৪২-১৪৫৯), তখন হজরত খানজাহান (র.) এ অঞ্চল আবাদ করে নামকরণ করলেন ‘খলিফাত-ই-আবাদ’ বা প্রতিনিধির অঞ্চল। মানুষের কল্যাণে তিনি তৈরি করলেন ষাটগম্বুজসহ অসংখ্য মসজিদ, দিঘি, রাস্তা এবং পত্তন করলেন অগণিত হাটবাজার। হজরত খানজাহান (র.)-এর আগমনকাল না জানা গেলেও এ সাধক পুরুষ পঞ্চদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বহু ধর্মপ্রাণ অনুসারীকে সঙ্গে নিয়ে যশোর জেলার বারবাজার হয়ে ভৈরব নদ অতিক্রম করে বাগেরহাটে পৌঁছান। তার মাজারগাত্রে উৎকীর্ণ শিলালিপি থেকে জানা যায়, ২৬ জিলহজ ৮৬৩ হিজরিতে (১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দ) তিনি ইন্তেকাল করেন। হজরত খানজাহান (র.)-এর তিরোধানের পর হোসেন শাহীর বংশধররা এ অঞ্চল শাসন করতেন। বঙ্গেশ্বর নসরত শাহের খলিফাত-ই-আবাদ টাঁকশাল বাগেরহাট শহরের সম্ভবত মিঠাপুকুরের কাছে অবস্থিত ছিল। মিঠাপুকুর পাড়ে সে আমলের একটি মসজিদ আছে। যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের সময় নির্মিত এক আকর্ষণীয় মঠ যাত্রাপুরের অযোধ্যায় (কোদলা) অবস্থিত। আজকের বাগেরহাট সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতাকে বয়ে বেড়াচ্ছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা বাগেরহাট বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেও সুন্দরবন অঞ্চলে দুর্ভেদ্য ঘাঁটি হিসেবে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। ১৭৮৬ সালে লর্ড কর্নওয়ালিসের শাসনামলে যশোরকে জেলা করা হয়। ১৮৪২ সালে খুলনা যখন যশোর জেলার একটি মহকুমা তখন বাগেরহাট খুলনার অন্তর্গত একটি থানা। ১৮৪৯ সালে মোড়েল উপাধিধারী দুজন ইংরেজ বাগেরহাটে মোড়েলগঞ্জ নামক একটি বন্দর স্থাপন করেন। ১৮৬১ সালের ২৬ নভেম্বর ‘মোড়েল-রহিমুল্লাহ’ নামে খ্যাত এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়, তখন সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র খুলনার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। সেই সংঘর্ষের তদন্ত তিনিই করেন এবং প্রশাসনিক প্রয়োজনে বাগেরহাটে একটি মহকুমা স্থাপন করার সুপারিশ করেন। ফলে ১৮৬৩ সালে বাগেরহাট মহকুমা হিসেবে যশোর জেলার অন্তর্গত হয়। ১৮৮২ সালে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট মহকুমা নিয়ে খুলনা জেলা গঠিত হয়। ১৯৮৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বাগেরহাট মহকুমা জেলায় উন্নীত হয়। বর্তমানে বাগেরহাট ৯টি উপজেলা, ৭৫টি ইউনিয়ন, ১০৪৭টি গ্রাম এবং ৩টি পৌরসভার সমন্বয়ে গঠিত একটি ‘এ’ ক্যাটাগরিভুক্ত জেলা। এ জেলায় ঐতিহাসিক ৬০ গুম্বুজ মসজিদ দেশের অন্যতম পর্যটকদের দর্শনীয় স্থান।