খুলনা প্রতিনিধি ॥ মাগুরা তার স্বকীয় সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। নান্দনিক কাত্যায়নী পূজা উদযাপন, শতবর্ষী ঘোড়দৌড়, লাঠিখেলা, নৌকাবাইচ, আর নবান্ন উৎসব সাংস্কৃতিক অঙ্গনে জেলাটিকে করে তুলেছে সুপরিচিত। জারিগান, হলয় গান এবং অষ্টক গানের উৎপত্তিস্থল মাগুরা। লোক সঙ্গীতের এই তিনটি ধারা দলীয় নৃত্যগীতের মাধ্যমে পরিবেশন করা হয়। সম্প্রীতির বার্তা দিতেই মাগুরাতে প্রতি বছর দূর্গাপূজার ঠিক একমাস পর বাংলা কার্তিক ও ইংরেজি নভেম্বর মাসে আয়োজিত হয় পাঁচদিনব্যাপী কাত্যায়নী পূজা ও মাসব্যাপী মেলা। বাংলাদেশে দূর্গাপূজা হিন্দু ধর্মীয় সবচেয়ে বড় উৎসব হলেও কাত্যায়নী পূজা মাগুরার হিন্দু সমাজের জন্য প্রধান উৎসব হিসেবে বিবেচিত। সমগ্র উপমহাদেশের আর কোথাও মাগুরার মত এতটা জাঁকজমকপূর্ণভাবে কাত্যায়নী পূজা উদযাপিত হয় না। কাত্যায়নী হিন্দু দেবী দুর্গার একটি বিশেষ রূপ এবং মহাশক্তির অংশবিশেষ। মাগুরা সদরের পারনান্দুয়ালী গ্রামের রূপচান সকারের (রাজবংশ মাঝি সম্প্রদায়) পুত্র কেষ্টপদ সরকার ১৯৩৯ সালে নিজবাড়ীর অঙিনায় সর্বপ্রথম এই পূজা শুরু করেন। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এখানে এ পূজা চলতে থাকে। ১৯৫৩ সাল থেকে পুনরায় পারনান্দুয়ালী গ্রামের সতীষ চন্দ্র মাঝি নিজ বাড়ীর আঙিনায় এ পূজা শুরু করেন। পরবর্তীতে মাগুরা নতুন বাজার এলাকায় এ পূজা জাঁকজমকপূর্ণভাবে শুরু হয়। এরপর থেকেই মাগুরার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে পূজাটি খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পূজা উপলক্ষ্যে গোটা শহরকে সাজানো হয় বর্ণিল সাজে। চোখ ধাঁধানো আলোকস্জ্জাসহ শহরের বিভিন্ন স্থানে তৈরি করা হয় দৃষ্টিনন্দন তোরণ, প্যান্ডেল। পূজামন্ডপগুলো তৈরি করা হয় প্রাচীন ইতিহাস, ঐতিহ্যর স্থাপত্যকলার আদলে এবং সাম্প্রতিক সময়ের উল্যেখযোগ্য ঘটনার আলোকে। মাগুরায় এই বর্ণিল আয়োজনের কাত্যায়নী উৎসবে অংশ নিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লাখ লাখ দর্শনার্থীদের পাশাপাশি নেপাল, ভারত ও অন্য দেশ থেকে বহু দর্শনার্থী ছুটে আসেন। পাঁচদিন পর পূজা শেষ হয়ে গেলেও কাত্যায়নী উৎসব কেন্দ্রিক জমজমাট মেলা চলে এক মাস ধরে। মেলায় সূইঁ-সূতা থেকে শুরু করে সবকিছু পাওয়া যায়। কাঠের আসবাবপত্র, মাটির তৈজসপত্র, খেলনা, পুতুলনাচসহ গ্রামীণ ঐতিহ্যের নানা আয়োজন থাকে। দেশের দূরদূরান্ত থেকে আসা ব্যবসায়ীরা মেলায তাদের পসরা সাজিয়ে বসেন। ধর্মীয় আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ মাসব্যাপী মেলা কাত্যায়নী পূজাকে আরো উৎসবমুখর করে তোলে। কাত্যায়নী পূজার জনসমাগমকে কেন্দ্র করে আজও পর্যন্ত কোন দুর্ঘটনার কথা শোনা যায়নি। এটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির
এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
শত বছরের ঐতিহ্যবাহী ঘোড়দৌড় এ জেলার সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের স্বাক্ষর বহন করে। আজ থেকে প্রায় ১২০ বছর আগে ১৮৯৮ সালে মাগুরা সদরসহ জেলা প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার সময় স্থানীয় অধিবাসীগণ মেলায় অংশগ্রহণ করে থাকেন। সদর উপজেলার বহারবাগ ও গাবতলা এবং মহম্মদপুর উপজেলার বড়রিয়ার ঘোড়দৌড় মেলা সুপ্রসিদ্ধ। শীত মৌসুমে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
মাগুরা জেলায় বিভিন্ন পার্বণকে ঘিরে স্থানীয় জমিদার ও ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ নৌকা বাইচের আয়োজন করতেন। বর্তমানে জাতীয় পর্যায থেকে শুরু করে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনসহ স্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সহযোগিতায় নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। বিশেষ করে মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলার মধুমতি নদীতে আয়োজিত বিহারীলাল শিকদার এর নামে যে নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হয় তাতে পার্শ্ববর্তী জেলাসহ মাগুরা জেলার লক্ষাধিক দর্শক সমবেত হয় আনন্দ উপভোগ করেন। অন্যদিকে দুর্গাপূজার পরদিন পলাশবাড়ীয়া ইউনিয়নের ঝামায় নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হয় যাতে ৫০,০০০ এর অধিক লোক উপস্থিত হয়ে থাকে। এছাড়াও মাগুরা সদরের কামারখালী ব্রীজের নিচে গড়াই নদীতে মরহুম এ্যাড. আসাদুজ্জামান স্মৃতি নৌকাবাইচ সাম্প্রতিক সময়ে শুরু। মাগুরা জেলার ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারলো না এই প্রজন্ম।