## যেকোন সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন পূর্ব অনিয়মে প্রার্থিতা হারালেন লক্ষ্মীপুরের স্বতন্ত্র প্রার্থী পবন
## আচরণ বিধি ভেঙেছে প্রায় ৫০০জন প্রার্থী; এক শম্ভূই শোকজ পেয়েছেন চারবার
জি এম শাহনেওয়াজ ঢাকা থেকে ॥ স্বাধীনতা পরবর্তী জাতীয় সংসদসহ যেকোন নির্বাচনের তুলনায় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আচরণ বিধি লঙ্ঘনে রেকর্ড ঘটনা ঘটেছে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) শোকজ ট্রিপল সেঞ্চুরি পার করেছে। আর আচরণ বিধি ভেঙেছেন ৪৮০ জন। প্রথম প্রার্থিতা হারিয়েছেন লক্ষ্মীপুর-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী হাবিবুর রহমান পবন। ডিসি ও এসপিকে বদলির হুমকি দেয়ার অপরাধে তার প্রার্থিতা বাতিল করলো ইসি। যেকোন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আচরণ বিধি ভঙ্গের কারণে এই প্রথম প্রার্থিতা হারালো কোন একজন প্রার্থী। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে প্রার্থীদের পাশাপাশি তাদের সমর্থকদের শোকজ করা হলেও আচরণবিধি লংঘন থামানো যাচ্ছে না। কেউ কেউ একাধিকবার শোকজের মুখোমুখি হয়েছেন। শোকজের পাশাপাশি মামলা ও জরিমানাও করা হচ্ছে। সর্বশেষ তিনবার শোকজের পর ইসিতে তলব করে বরগুনা-১ আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী অ্যাডভোকেট ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এরপরও তিনি আচরণবিধি লংঘন করেছেন। ফলে তাকে চতুর্থবারের মতো শোকজ করা হয়েছে। গত রবিবার ম্যাজিস্ট্রেটদের উদ্দেশ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, সরকার ক্ষমতায় থেকেও যে নির্বাচন সুষ্ঠ হতে পারে সেটি এবার প্রমাণ করতে হবে। সেজন্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব সবাইকে স্বচ্ছতার সঙ্গে পালন করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে সিংহভাগ শোকজের ঘটনা ঘটেছে। এর বাইরে আচরণবিধি লঙ্ঘনের মাত্রা কিছুটা বেশি এমন ডজন খানের প্রার্থীকে নির্বাচন কমিশন সরাসরি তলব করা হয়। শোকজের মুখে পড়া বেশিরভাগ প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকরা দুঃখ প্রকাশের মধ্য দিয়ে পার পেয়েছেন। এর বাইরে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী ঝিনাইদহ-২ আব্দুল হাই ও চট্টগ্রাম-১৬ মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। পাশাপাশি একই দলের বরগুনা-১ ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুকে ৫০ হাজার টাকা ও কুমিল্লা-৬ আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারকে এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড করা হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য প্রার্থী ও সমর্থকদের ৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা হয়েছে। ইসি সূত্র জানায়, জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপারকে (এসপি) বদলির হুমকি দেয় লক্ষ্মীপুর-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান পাবন। এ ঘটনায় তাকে শোকজ করা হয়। গত সোমবার তাকে সশরীরের নির্বাচন ভবনে হাজির ও ব্যাখ্যা তলবের শুনানি করে কমিশন। গতকাল মঙ্গলবার অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় তার প্রার্থিতা বাতিল করেছে কমিশন। এর আগে গত ২৬ ডিসেম্বর বরগুনার তালতলী উপজেলার কড়াইবাড়িয়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রচারণা সভায় ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সমালোচনা করে ইবলিশ, ইডিয়ট ও মোনাফেকের দল বলে মন্তব্য করেন। এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ চারবার শোকজ করা হয়েছে নৌকার এই প্রার্থীকে। আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কাছে জরিমানা গুনতে হয়েছে নড়াইল-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মুর্তজাসহ চার প্রার্থীকে। গত ১ জানুয়ারি পর্যন্ত নির্বাচন অনুসন্ধান কমিটির রিপোর্ট পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দশটি বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে। এ বিভাগে ১১৯জন প্রার্থীকে আচরণ বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে কমিটির পক্ষ থেকে নোর্টিশ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৬৬ জনের বিরুদ্ধে শোকজ ও দায়মুক্তি দিয়ে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। নথি উপস্থাপন ও অনুমোদিত প্রতিবেদন দেয়া হয় ১৭ জনের, ২১ জনের প্রতিবেদন নিষ্পতির অপেক্ষায় এবং চলমান প্রতিবেদন রয়েছে ২৮ প্রার্থীর বিরুদ্ধে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে রাজশাহী বিভাগ। এ বিভাগে ৭৪ জন প্রার্থীকে আচরণ বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে কমিটির পক্ষ থেকে নোর্টিশ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে শোকজ ও দায়মুক্তি দিয়ে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। নথি উপস্থাপন ও অনুমোদিত প্রতিবেদন দেয়া হয় ১০ জনের, ১৩ জনের প্রতিবেদন নিষ্পতির অপেক্ষায় এবং চলমান প্রতিবেদন রয়েছে ১৫ প্রার্থীর বিরুদ্ধে। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে কুমিল্লা বিভাগ। এ বিভাগে ৬৮ জন প্রার্থীকে আচরণ বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে কমিটির পক্ষ থেকে নোর্টিশ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৪০ জনের বিরুদ্ধে শোকজ ও দায়মুক্তি দিয়ে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। নথি উপস্থাপন ও অনুমোদিত প্রতিবেদন দেয়া হয় ১০ জনের, ১৬ জনের প্রতিবেদন নিষ্পতির অপেক্ষায় এবং চলমান প্রতিবেদন রয়েছে ১৪ প্রার্থীর বিরুদ্ধে। চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে ময়মনসিংহ বিভাগ। এ বিভাগে ৪৯ জন প্রার্থীকে আচরণ বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে কমিটির পক্ষ থেকে নোর্টিশ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে শোকজ ও দায়মুক্তি দিয়ে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। নথি উপস্থাপন ও অনুমোদিত প্রতিবেদন দেয়া হয় ০৪ জনের, ১৬ জনের প্রতিবেদন নিষ্পতির অপেক্ষায় এবং চলমান প্রতিবেদন রয়েছে ১৫ প্রার্থীর বিরুদ্ধে। পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগ। এ বিভাগে ৩৮ জন প্রার্থীকে আচরণ বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে কমিটির পক্ষ থেকে নোর্টিশ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৮ জনের বিরুদ্ধে শোকজ ও দায়মুক্তি দিয়ে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। নথি উপস্থাপন ও অনুমোদিত প্রতিবেদন দেয়া হয় ৫ জনের, ৬ জনের প্রতিবেদন নিষ্পতির অপেক্ষায় এবং চলমান প্রতিবেদন রয়েছে ৭ প্রার্থীর বিরুদ্ধে। ৬ষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে রংপুর বিভাগ। এ বিভাগে ২৯ জন প্রার্থীকে আচরণ বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে কমিটির পক্ষ থেকে নোর্টিশ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২৭ জনের বিরুদ্ধে শোকজ ও দায়মুক্তি দিয়ে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। নথি উপস্থাপন ও অনুমোদিত প্রতিবেদন দেয়া হয় ১১ জন এবং প্রতিবেদন নিষ্পতির অপেক্ষায় চলমান রয়েছে ১৬ প্রার্থীর বিরুদ্ধে। এর পর বরিশাল যথাক্রমে ২৭ জন, ১৮ জন, ৮ জন, ৮ জন ও ২জন, ফরিদপুরে ২০ জন. ২০ জন ১০, ৬ ও ৪ জন এবং সিলেটে ১৬ জন, ১৫ জন, ৯ জন ও ৬ জন। গত ১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৪৮০ জনকে বিভিন্ন অপরাধে শোকজের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবেদন দিয়েছে ৩০৪ জন প্রার্থীর বিরুদ্ধে, নথি উত্থাপনের কমিশন থেকে অনুমোদন পেয়েছে ১০১ জন প্রার্থীর বিরুদ্ধে, নথি উত্থাপন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ৮৬টি এবং নথি চলমান রয়েছে ১১৭ জন প্রার্থীর বিরুদ্ধে। আগামী ৭ জানুয়ারি ভোট। প্রতিদিনই আসছে অভিযোগ। কিন্তু নথি উত্থাপন ও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে সব অভিযোগের নিষ্পত্তি করা অল্পদিনের মধ্যে কমিশনের জন্য চ্যালেঞ্জ হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন বলেন, দল ও দল সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী এই নির্বাচনে রেকর্ড সংখ্যক প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছে। ফলে ভোটারের কাছে যাওয়ার চেয়ে মাঠ দখলের লড়াইকে বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছেন প্রার্থীরা বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করছি। তা না হলে এতো বেশি আচরণ বিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটার কথা না। কমিশন একজন প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করেছে। এই কাজটি প্রচারণা শুরুর শুরুতে ঘটালে অন্য প্রার্থীদের জন্য এলারমিং হতো। সবাই সর্তক থাকত। আচরণ বিধি লঙ্ঘনের ঘটনা কম ঘটত। যা-হোক শেষ মুহুর্তে এসেও কমিশন সুষ্ঠু ভোটগ্রহনের কঠোর অবস্থানে থাকায় নির্বাচনের অগ্রহযোগ্যতা বাড়বে।