কয়রা প্রতিনিধি ॥ শীতের মিষ্টি-কড়া রোদ পোহাতে পোহাতে “কুমড়ো বড়ি” তৈরি করা গ্রামের বধুদের প্রাচীন ঐতিহ্য। প্রতি বছর শীত মৌসুমে গ্রাঞ্চলের বেশিরভাগ বাড়ীতে এ বড়ি তৈরির রেওয়াজ রয়েছে। অতীতে এটা তৈরির সময় প্রতিবেশী গৃহবধু-মেয়েরা এক বাড়ীতে জড়ো হত। গান-গল্প হাসি রহস্যো মধ্যে চলতো এই সৃষ্টিশীল কাজ। যার মাধ্যমে প্রতিবেশী পরিবারগুলোর মধ্যে সু-সম্পর্ক বজায় থাকতো। বিলুপ্তপ্রায় এই ঐতিহ্য আজো ধরে রেখেছেন কয়রা উপজেলার গৃহবধুরা। মাছ ঝোলে বা সবজির সঙ্গে কুমড়োর বড়ি বাঙালির ঐতিহ্যবাহী খাবার। বাজারে বিভিন্ন ধরনের কুমড়ো বড়ি পাওয়া গেলেও চালকুমড়া অথবা মুলার সঙ্গে মাষকলাই ডাল মিশিয়ে তৈরি বড়ি স্থানীয়দের খুবই প্রিয়। তাই সাত সকালে গ্রামে গিয়ে দেখা যায় সুস্বাদু ও পুষ্টিকর খাবার কুমড়ো বড়ি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন গৃহবধুসহ মেয়ে ও শিশুরা। মহারাজপুর ইউনিয়নে মঠবাড়ী গ্রামে রাস্তার পাশে উচু সবজি খেতে রবিবার সকালে দেখা যায় কুমড়ো বড়ি রোদে শুকাচ্ছেন কয়েকজন গৃহবধু। খেজুর পাতায় বোনা পাটির উপরে বাদ দেওয়া শাড়ী অথবা কাথা পেতে তার উপর ডান হাতের আঙ্গুলের আলতো চাপে কুমড়ো বড়ি সাজাচ্ছে তারা। মায়ের কাজে সাহায্য করছে মাধ্যমিক পড়ুয়া মেয়ে। তাদের এই নিখুত কাজ দেখছেন মঠবাড়ী রাস্তায় পথচারী লোকজন। দাড়িয়ে দেখতে থাকা মঠবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা অভিরোন নেছা প্রতিবেদকে জানান, এই খাবার অত্যান্ত পুষ্টিকর ও সুস্বাদু। মাছের চাহিদাও মেটায়। বড়ি তৈরির পদ্ধতি জানাতে গিয়ে মঠবাড়ী গ্রামের গৃহবধু ফুলবিবি (৫০) বলেন, বড়ি দেওয়ার আগের দিন মাষকলাই ডাল খোসা ছাড়িয়ে পরিষ্কার পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। সন্ধ্যায় চালকুমড়োর খোসা ছাড়িয়ে ভেতরের নরম অংশ ফেলে পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে নিতে হবে। এরপর মিহি করে কোরানো কুমড়ো পরিষ্কার কাপড়ে বেঁধে সারারাত ঝুলিয়ে রাখতে হবে। পরদিন ভোরে ডালের পানি ছেঁকে মিহি করে বেটে পেষ্ট তৈরি করতে হবে। পানি ঝরানো কুমড়োর সঙ্গে প্রায় সমপরিমান ডাল ও পরিমান মত লবণ মেশাতে হয়। পরে কড়া রোদে পরিস্কার কাপড়, বা নেটের উপর ছোট ছোট করে বড়ি দিতে হয়। এই বড়ি ভালো করে শুকিয়ে সংরক্ষণ করলে অনেকদিন পর্যন্ত খাওয়া যায় বলে জানান ফুলবিবি। শ্রীরামপুর গ্রামের তানজিলা খাতুন বলেন, শীত না পড়লি বড়ি যুত (ভাল) হয় না। যত বেশি শীত পড়বে তত বড়ির স্বাদ হবে। খাতি ভাল লাগবে। শীত এলেই একে অপরকে বড়ি দিতে সাহায্য করা তাদের গ্রামের রেওয়াজ। বছর পচিশেকে আগে শশুর বাড়ীতে এসে তিনি শাশুড়ির কাছ থেকে এ রেওয়াজে অভ্যস্ত হয়েছেন। তবে এ ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়ার পথে বলে তিনি মনে করেন। শ্রীরামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মোছাঃ মনিরুন্নেছা বলেন, শীতকাল কুমড়ার বড়ি তৈরির উপযুক্ত সময়। পৌষ-মাঘ মাসে নতুন ডাল ও গাছ পাকা চাল কুমড়া দিয়ে বড়ি ভাল হয়। গরমের সময় কিংবা চাল কুমড়া পুরানো হলে কিংবা বাত্তি না হলে বড়ি টক হয় এবং ফেটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে । এছাড়া সে বড়িগুলো বেশিদিন রাখা সম্ভা হয়না। এক সপ্তাহ রোদে শুকানোর পর বড়িগুলো সংরক্ষনের উপযোগি হয়। শুষ্ক এই মৌসুমে তৈরিকৃত কুমড়োর বড়ি সারা বছর টিনের পাত্রে সংরক্ষন করা হয়। বিশেষ খাবার হিসেবে এর কদর রয়েছে। রান্নার সময় কুমড়োর বড়িগুলো তেলে হালকা ভেজে তরকারিতে দেওয়া হয়। ভেজে মচমচে করে শুধু কুমড়োর বড়ি খেতেও মজার। নতুন প্রজন্মের মেয়েরা এসব শিখতে কিম্বা বড়ি তৈরি করতে আগ্রহ না। তারা এই রেওয়াজ থেকে পিছিয়ে পড়ছে, তাতে আগামীতে এটা হারিয়ে যাবে। এই উপজেলায় প্রায় ২০ ভাগ পরিবার শীতকালে কুমড়োর বড়ি তৈরি করে বলে দাবি করেন। কয়রা উপজেলা স্বস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তার এম আর এ হাসান জানান, কুমড়োর বড়ি তৈরির অধিকাংশ উপকরণ (চালকুমড়া, মাসকলাই, মূলা) পুষ্টিকর খাবার। এগুলো যতটা স্বস্থ্যসম্মত উপায়ে তৈরি করা যায় ততই মঙ্গল। উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, প্রতি ১০০ গ্রাম মাসকলাইতে আছে ৩৪১ মিলিগ্রাম ক্যালরি, ৯৮৩ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম, প্রোটিন ২৫ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১৩৮ মিলিগ্রাম, আয়রন ৭ দশমিক ৫৭ মিলিগ্রাম। অপর দিকে চালকুমড়া একটি পুষ্টিকর সবজি। এতে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন, মিনারেল, ও ফাইবার রয়েছে তাই চাল কুমড়ার উপকারিতা অনেক। যক্ষা , কোষ্ঠকাঠিন্য ও গ্যাষ্ট্রিকসহ বহু রোগের উপশমও করে চাল কুমড়া। সব মিলিয়ে কুমড়ো বড়ি নিঃসন্দেহে একটি সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর খাবার।