আলহাজ্ব প্রফেসর মো. আবু নসর
মিরাজ আরবি শব্দ। মূল শব্দ ‘উরুজ’ অর্থাৎ উত্থান। সাধারণ অর্থে ঊর্ধ্বারোহন বা সিঁড়ি বা সোপান। অন্য অর্থ ঊর্ধোলোকে আরোহন বা মহামিলন। এটি একটি অলৌকিক ঘটনার স্পষ্ট ইঙ্গিত, যার সাথে রয়েছে ঈমানের গভীরতম সম্পর্ক। মহাবিশ্বের মহাবিস্ময়কর ঘটনা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) উর্ধ্বলোকে গমন, যা লাইলাতুল মিরাজ বা শবে মিরাজ নামে পরিচিত। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এঁর ২৩ বছরের নবুওয়াতী জীবনের অন্যতম ঘটনা হলো ‘মিরাজ’। ইসলামী পরিভাষায় মিরাজ হলো মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কর্তৃক সশরীরে সজ্ঞানে জাগ্রত অবস্থায় হযরত জিব্রাঈল (আ.) ও হযরত মিকাঈল (আ.) সমভিব্যাহারে মহান রাব্বুল আলামীনের সাথে দিদার লাভ। নবীজি (সা.) আল্লাহর অশেষ রহমতে উর্ধ্বাকাশে আরশে আজিমে ভ্রমণ করেছেন- এই বিশ্বাস রাখা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপরিহার্য। হিযরতের পূর্বে রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে নবীজি (সা.) আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমতে উর্ধ্বাকাশে আরোহণ করেছিলেন এবং আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে সাক্ষাত লাভ করেন। সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর ৬৩ বছর জীবনের অসংখ্য ও অগনিত বিশেষত্বের মধ্যে সবচেয়ে গৌরবমন্ডিত, বৈশিষ্টমন্ডিত, গৌরবজ্জল ও চমকপ্রদ ঘটনা হলো মিরাজ বা উর্ধ্বজগত ভ্রমন। রাসুল (সা.) এর জীবনের সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা হলো মিরাজ। মিরাজের বৈজ্ঞানিক যুক্তি খুঁজতে যাওয়া অবান্তর চিন্তামাত্র। কারণ যুক্তি ঈমানের ভিত্তি নয় বরং ঈমানই যুক্তির ভিত্তি। যুক্তির ক্ষমতা যেখানে শেষ, ঈমানের যাত্রা সেখান থেকে শুরু। মিরাজ মূলত: একটি মোজেজা। মিরাজ বিশ্বের ইতিহাসে শুধু সাধারণ ঘটনা নয় বরং মানবতার মুক্তির দূত নবীকুল শিরোমনি হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর জীবনে একটি অত্যাশ্চর্য ও বিস্ময়কর অধ্যায়। ইসলামের ইতিহাসে পবিত্র শবে মিরাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবোধ সম্পন্ন। প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর ৫০ বছর বয়সে অর্থাৎ নবুয়াতের দশম বর্ষে, হিজরতের দেড় বছর পূর্বে ৬২০ খৃষ্টাব্দের রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে লাইলাতুল মিরাজের মহিমান্বিত ও বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। মিরাজের প্রথম পর্যায়ে অর্থাৎ মক্কা নগরের কাবা শরিফে বা মসজিদুল হারামের হাতিম থেকে পবিত্র জেরুজালেমের মসজিদুল আকসা অবধি বোরাকে আরোহন ও অবতরণ করা পর্যন্ত ইহলোক ভ্রমনকে ‘ইসরা’ বলা হয়। এখান থেকেই নূরের চলন্ত সিঁড়ি যোগে মহাকাশ তথা উর্ধ্বলোকে সফরকে ‘মিরাজ’ বলে। সামগ্রিক ভাবে এ নভোমন্ডল পরিভ্রমন শবে মিরাজ নামে পরিচিত। পৃথিবীর ইতিহাসে এহেন শীর্ষ স্থানীয় ও যুগান্তকারী ঘটনা পবিত্র কুরআনে একাধিক সুরায় ও হাদিস শরীফে সর্বস্তরে লাইলাতুল মিরাজের বর্ননা রয়েছে। বর্ননায় জানা যায়, মহান আল্লাহ তাআলার নির্দেশে মহানবী (সা.) কে কাবা শরীফ সংলগ্ন স্থান হাতিমের কাছে নিয়ে আসা হয়। এরপর যমযমের নিকট নিয়ে তাকে সিনা চাক বা বক্ষ বিদারণ করা হয়। তারপর যথা সময়ে পানি দ্বারা ধৌত করে ঈমান ও হিকমত দ্বারা পরিপূর্ন ও শক্তিশালী করতঃ পুনরায় যথাস্থানে সংস্থাপন করা হয়। এরপর রাসুল (সা.) অজু করে হাতিমের নিকট ২ রাকাত নফল নামাজ আদায় করেন। পরে বিদ্যুতের চেয়ে দ্রুতগতি সম্পন্ন একটি বেহেশতী যান “বোরাকে” নবীজিকে আরোহন করানোর সঙ্গে সঙ্গেই তা দ্রুতগতিতে ছুটতে থাকে। এক হাজার মাইল দূরত্বে প্রথমে মদিনা মুনাওয়ারা পরে সিনাই পর্বত, তারপর হযরত ঈসা (আ.) এরজন্ম স্থান “রায়তে লাহম” হয়ে এক নিমিষে চোখের পলকে জেরুজালেমের মসজিদুল আকসা তথা বায়তুল মুকাদ্দসে গিয়ে পৌঁছালেন। এখানে সকল নবী রাসুল নবিজীকে প্রানঢালা স্বাগতম ও অপূর্ব সংবর্ধনা জানান। হযরত জিব্রাঈল আমিন আযান ও ইকামত দেন। নবী রাসূলদের মুকুট মনি রাসুল (সা.) সেখানে আম্বিয়া কেরামগনের সঙ্গে দুই রাকাত নামাজের জামাতে ইমামতি করেন। তিনি হলেন ইমামূল মুরসালিন অর্থাৎ সকল নবী রসূলের ঈমাম। নামাজের পর জিব্রাঈল (আ.) উপস্থিত সকলের সঙ্গে রাসুলাল্লাহ (সা.) এর আনুষ্ঠানিক পরিচয় করিয়ে দেন। নৈশভ্রমনের প্রথমাংশ সমাপ্ত হওয়ার পর নবী করিম (সা.) পুনরায় বোরাকে আরোহন করলে তা দ্রুতগতিতে ঊর্ধ্বলোকে যাত্রা শুরু করে। প্রথম আসমানে হযরত আদম (আ.), দ্বিতীয় আসমানে হযরত ঈসা (আ.) ও ইয়াহিয়া (আ.), তৃতীয় আসমানে হযরত ইউসুফ (আ.), চতুর্থ আসমানে হযরত ইদ্রিস (আ.), পঞ্চম আসমানে হযরত হারুন (আ.), ষষ্ঠ আসমানে হযরত মুসা (আ.) এবং সপ্তম আসমানে হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর সঙ্গে মহানবী (সা.) এর সাক্ষাত হয় এবং পরষ্পর শুভেচ্ছা ও কুশল বিনিময় হয়। সপ্তম আসমানে অবস্থিত আসমানি ক্বাবাগৃহ বায়তুল মামুরে তিনি অসংখ্য ফেরেস্তাদের নামাজ আদায় করতে দেখেন। এরপর তিনি জিব্রাঈল (আ.) এর সঙ্গে বেহেস্থ ও দোযখ পরিদর্শন করেন। এভাবে সপ্তম আসমান থেকে ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ পর্যন্ত এসে সফর সঙ্গী হযরত জিব্রাঈল (আ.), হযরত মিকাঈল (আ.) ও রাসুলাল্লাহ (সা.) এর ঐশী বাহন বোরাকের গতি স্থির হয়ে যায়। জিব্রাঈল (আ.) এখানে থমকে দাড়িয়ে মহানবী (সা.) কে বললেন যে, সামনে অগ্রসর হওয়ার আর কোন ক্ষমতা তার নেই। এখানেই রাসুলাল্লাহ (সা.) ফেরেশতা জিব্রাঈল (আ.) কে তার স্বরূপে দেখতে পান। সিদরাতুল মুনতাহায় মহানবী (সা.) চারটি প্রবাহমান নদী দেখতে পেলেন। দুইটি ভিতরের দিকে প্রবাহিত ও দুইটি বাইরে। মহানবী (সা.) নদীগুলোর নাম সম্পর্কে হযরত জিব্রাইল (আ.)কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, ভিতরের দুটি বেহেশতের সালসাবিল ও কাউসার নদী। আর বাইরের দুটি মিশরের নীল ও ইরাকের ফুরাত নদী। নবীজির বাহনের এখানে (সিদরাতুল মুনতাহা) পরিবর্তন হয়। ‘রফরফ’ নামক বিশেষ স্বর্গীয় বাহনে আরোহণ করে রাব্বুল আলআমিনের অসীম কুদরতে কল্পনাতীত দ্রুত বেগে ৭০ হাজার নূরের পর্দা পেরিয়ে আরশে মোয়াল্লার (আরশে আজীম) সন্নিকটে পৌছায়ে মহান আল্লাহ’র দরবারে হাজির হলেন মহানবী (সা.)। নূর আর নূরের সৌরভের মহাসমারোহে তিনি অভিভূত হয়ে যান। এখানেই আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর দিদার লাভ ও কথোপকথন হয়। হযরত মুহাম্মদ (সা.) একমাত্র মহামানব যিঁনি আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্য লাভ করেন। রাসুলাল্লাহ (সা.) করুণা ও শুভেচ্ছার নিদর্শণ স্বরূপ পুরষ্কার হিসেবে আল্লাহ’র বান্দাদের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের হুকুম নিয়ে ওই রাত ও ঊষার সন্ধিক্ষণে আবার মক্কায় নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। বর্ণনায় পাওয়া যায়, মিরাজের রাতে উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য প্রথম পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হলেও পথিমধ্যে হযরত মুসা (আ.) এর পরামর্শে আল্লাহর দরবারে সুপারিশক্রমে ১০বারে কমতে কমতে পাঁচ ওয়াক্তে এসে দাঁড়ায়। তবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজের সমান সওয়াবদানভুক্ত হিসেবে গৃহীত হয়। সুতরাং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পবিত্র শবে মিরাজের উপহার। এখানে আরো উল্লেখ্য যে, নামাজ যেহেতু আল্লাহর প্রতি বান্দার আনুগত্যের বাস্তবরূপ সেহেতু নামাজ আল্লাহর সঙ্গে মিরাজ সমতূল্য। নামাজের মাধ্যমেই আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করা যায় এবং মুমিনগণ আত্মিকভাবে আল্লাহর দিদার পেয়ে থাকে। বস্তুত: মহানবী (সা.) এর মিরাজ একটি বিস্ময় সৃষ্টিকারী মোজেজা। এটির অনুপম শিক্ষা, বিভিন্ন দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা প্রদান করে। মহাবিশ্বে পরিভ্রমণের মাধ্যমে সৃষ্টি রহস্য উদঘাটনের পরম সৌভাগ্য রাসুল্লাহ (সা.) কে প্রদান করে মানব মর্যাদার শ্রেষ্ঠত্ব আল্লাহতায়ালা মিরাজের মাধ্যমে নির্ধারণ করেছেন। এ রাতে বায়তুল মোকাদ্দাসে মহানবী (সা.) এর ইমামতিতে হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে সকল নবী রাসুলের নামাজ আদায় করার মাধ্যমে নবীজির সর্বশ্রেষ্ঠত্ব ও তার নৈতিক, আদর্শিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষার অনুসরণীয় বিশ্বজনীন স্বরূপটিই প্রমাণিত হয়। তাই পবিত্র মিরাজের শিক্ষা স্রষ্টার ইবাদত, সৃষ্টির সেবা ও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ।
লেখক: প্রফেসর আলহাজ্ব মো. আবু নসর,
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, কলারোয়া সরকারি কলেজ, সাতক্ষীরা।
সাবেক কলেজ পরিদর্শক, যশোর শিক্ষা বোর্ড।
সাবেক ডেপুটি রেজিস্ট্রার, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
মোবা: ০১৭১৭-০৮৪৭৯৩