আলহাজ্ব প্রফেসর মো. আবু নসর
আরবী মাসগুলির মধ্যে শাবান মাস একটি মোবারকময় মাস। রাসুল (সা.) এ মাসে রোজাসহ অন্যান্য ইবাদত বেশি করতেন। রমজানের প্রস্তুতির মাস হিসেবে তিনি এ মাসকে পালন করতেন। এ মাসের একটি রাতকে মুসলমানরা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। মধ্য শাবানের এই রাত আমাদের কাছে ‘শবে বরাত’ হিসেবে পরিচিত। আল্লাহ তাআলা এ রাতে বান্দাদের জন্য তার অশেষ রহমতের দরজা খুলে দেন। মহিমান্বিত এ রাতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা বিগত জীবনের সব ভুল-ত্র“টি ও পাপ তাপের জন্য গভীর অনুশোচনায় আল্লাহর দরবারে সকাতরে ক্ষমা প্রার্থনা করে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্নিত, রাসুল (সা.) বলেন- ইসলামে এমন কতকগুলো পবিত্র রাত রয়েছে যে রাতগুলোর দোয়া ফিরিয়ে দেয়া হয় না। তন্মধ্যে রজব মাসের প্রথম রাত, শাবান মাসের ১৪ তারিখের রাত তথা শবে বরাতের রাত, শবে কদরের রাত, জুম্মার রাত, ঈদুল ফিতরের রাত, ঈদুল আজহার রাতের দোয়া ইত্যাদি প্রণিধানযোগ্য। হাদিস শরীফে এসেছে, নিশ্চয়ই উল্লিখিত রাতগুলোর দোয়া আল্লাহ কবুল করেন। আরবি শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে মহিমান্বিত শবে বরাত বা লাইলাতুল বরাত বলা হয়। একে হাদিসের পরিভাষায় লাইলাতুন নিসফি বিন শাবান বা শাবানের অর্ধ মাসের রাত বলা হয়। শব ফারসী শব্দ। এর অর্থ রজনী বা রাত। আর বরাত শব্দের অর্থ ভাগ্য/সৌভাগ্য। শবে বরাতকে আরবীতে লাইলাতুল বারাত নামে অবিহিত করা হয় যার অর্থ ভাগ্য রজনী বা বিমুক্তির রজনী। আরবী লাইলাতুন শব্দের অর্থ রাত বা রজনী আর বারাত শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো অব্যাহতি, দায়মুক্তি, নাজাত, নিস্কৃতি প্রভৃতি। লাইলাতুল বারাত অর্থাৎ পাপ মুক্তির রজনী বা নিস্কৃতির রাত। শবে বরাত হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত এক বরকতময় সুবর্ণ সুযোগ। অফুরন্ত কল্যাণে ভরা এই রজনী বান্দার জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশেষ নিয়ামত। এ রাতে আল্লাহর খাঁটি বান্দারা মহান সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে ক্ষমা, রিজিক বা বিপদ মুক্তি লাভ করে থাকেন। তাই এ রাতকে লাইলাতুল বারাত বা শবে বরাত বলা হয়। পবিত্র শবে বরাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিশেষ তাৎপর্যময় মুক্তির রজনী। মহান আল্লাহর বিরাগভাজন ও রোষানল থেকে বান্দা তওবার মাধ্যমে মার্জনা প্রাপ্ত হয়ে নিস্কৃতি লাভের পর আল্লাহ তাআলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে, তিনি পাপরাশি ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ মানব জাতিকে পৃথিবীতে প্রেরণের বহু পূর্বে তাদের রিযিক নির্ধারণ করে রাখলেও প্রতি বছর একজন মানুষের জীবনে যা ঘটবে তা নির্ধারণ করা হয় শাবান মাসের পবিত্র শবে বরাতে। এই রাতে সৃষ্টিকুলের প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি যেমন জন্ম, মৃত্যু, রিজিক-দৌলত, উত্থান-পতন, সুখ-দুঃখ, ভাল-মন্দ, রোগ-ব্যাধি ইত্যাদি পরবর্তী বছরের জন্য লিপিবদ্ধকৃত ও স্থিরকৃত হয়ে থাকে। এ বরকতময় রাতে বান্দার জন্য আল্লাহর রহমতের ফল্গুধারা উন্মুক্ত থাকে। এ রাতে আল্লাহ প্রেরিত ফেরেশতারা ইবাদতকারী বান্দাদের সঙ্গে একান্তভাবে মিশে যান। শবে বরাতের তাৎপর্য সম্পর্কে বেশ কয়েকটি হাদিস রয়েছে। প্রিয় নবী (সা.) মধ্য শাবানের দিবসে সিয়াম পালনের এবং রাত জেগে ইবাদত বন্দেগি করার তাগিদ দিয়েছেন। হযরত ইমাম গাজ্জালী (রহ.) বলেছেন, শবে বরাত হচ্ছে ফেরেশতাদের জন্য ঈদ উৎসব। যুগ শ্রেষ্ঠ সুখি কুতুবুল আলম হযরত মাওলানা শাহ সুফি আলহাজ্ব তোয়াজ উদ্দিন (রহ.) বলেছেন, রমজানকে খোশ আমদেদ জানানোর রাত এবং লাইলুল কদরে যাওয়ার সড়ক নির্মানের রাত শবে বরাত। শবে রবাতের গুরুত্ব সম্পর্কে হাদিসে বিশদ আলোচনা বিদ্যমান। হুজুর (সা.) শাবান মাসকে নিজের সঙ্গে অধিক সম্পৃক্ত করেছেন। হযরত আসমা ইবনে জায়েদ (রা.) সূত্রে বর্ণিত রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘শাবান মাস আমার মাস, আর রমজান মাস আল্লাহর মাস’। মহান আল্লাহ শবে রবাতের রজনীতে মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন। শবে বরাতে আল্লাহ তার বান্দাদের দোজখের শাস্তি থেকে মুক্তিদান করেন। এ রজনীতে বান্দাদের অধিক হারে আল্লাহর ইবাদত করা এবং পরের দিন রোজা রাখা একান্ত কর্তব্য। শবে বরাতের রাতে মহান আল্লাহ তাআলা সূর্যাস্তের পর প্রথম আসমানে অবতীর্ন হন এবং আহব্বান করতে থাকেন, আছে কি কেউ ক্ষমা প্রার্থনাকারী আমি তাকে ক্ষমা করবো, আছে কি কোন রিজিক অন্বেষণকারী, আমি তাকে রিযিক দান করবো, আছে কি কেউ বিপদগ্রস্থ, আমি তাকে বিপদ মুক্ত করবো। এভাবে সুবেহ সাদেক পর্যন্ত আহবান করতে থাকেন। শবে বরাতে করণীয় কর্তব্যের মধ্যে রাতে জাগ্রত থেকে আল্লাহর ইবাদত ও পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করা, অধিক হারে দোয়া দরুদ পাঠ করা, রাতে বেশি বেশি নফল নামাজ পড়া, পরবর্তী দিনে নফল রোজা রাখা, জিকির-আসকার, মিলাদ-মাহফিল, তাজবিহ-তাহলীল, তওবা-ইস্তেগফার, মৃত ব্যক্তিদের কবর জিয়ারত করা ও তাদের জন্য দোয়া করা, দেশ, জাতি তথা মুসলিম উম্মাহর শান্তি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য আল্লাহর রহমত কামনা করে বিশেষ মুনাজাত করা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তবে শবে বরাতের কোন ধরাবাঁধা ইবাদত নেই। শবে রবাত আঢ়ম্বরতার মধ্যে নয় বরং নৈতিক চরিত্রবলের সাধনার মাধ্যমে করুণাময়ের অশেষ করুনা লাভের আন্তরিক প্রয়াসই এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। তাই মুক্তির বার্তা নিয়ে পবিত্র শবে বরাতে প্রতিটি মুসলমানদের যাবতীয় ফজীলত অর্জনের জন্য সচেষ্ট হওয়া উচিত। উল্লেখ্য যে, সাহাবায়ে কেরামগন (মুসলমানদের) আসন্ন রমজান মাসকে নিদের্শনা অনুযায়ী সুষ্ঠভাবে অতিবাহিত করার পূর্ব প্রস্তুতি এই শাবান মাসেই গ্রহন করতেন। পবিত্র রবকতময়, পূণ্যময় ও মহিমান্বিত এ রজনীর আলোকচ্ছটায় মুসলমানদের অন্তরাত্না হোক চির উদ্ভাসিত। অনাবিল শান্তি ও সমৃদ্ধি আসুক ঘরে ঘরে। এই রাত সমগ্র দেশ, জাতি ও বিশ্বমানবতার জন্য সার্বজনীন কল্যাণ বয়ে আনুক এটাই হোক বাস্তবতা।
লেখক: আলহাজ্ব প্রফেসর মো. আবু নসর
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, কলারোয়া সরকারি কলেজ, সাতক্ষীরা।
সাবেক কলেজ পরিদর্শক, যশোর শিক্ষা বোর্ড, যশোর।
সাবেক ডেপুটি রেজিস্ট্রার, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, ঢাকা।