দৃষ্টিপাত রিপোর্ট ॥ একুশ বছর আগে ২০০৩ সালে সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার লক্ষীনাথপুর গ্রামে এক অপার সম্ভাবনাময় শিশু কন্যা রাজিয়ার জন্ম হয়, দেশ সেরা ফুটবলার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া জাতির এই বীরাঙ্গনা সন্তান রাজিয়া নামক সেই আলোকিত সূর্য গত ১৩ মার্চ অস্তমিত হয়। সতের কোটি মানুষের আশা ইচ্ছা, সম্মান, মর্যাদাকে প্রতি মূহুর্তে উচ্চতায় নেওয়া বাংলাদেশ মহিলা ফুটবল দলের সদস্যদের অন্যতম আলোর বিচ্ছুরন ঘটানো রাজিয়া সুলতানা। সাতক্ষীরা কন্যা রাজিয়ার মৃত্যু কোন ভাবেই মেনে নেওয়া যাচ্ছে না তবে বাস্তবতা হলো দেশ সেরা এই নারী ফুটবলার আমাদের মাঝে নেই। জন্মালে মৃত্যু হবে এটাই শ্বাসত তবে রাজিয়ার মৃত্যু সত্যিকার অর্থে অবহেলার দায়ে দুষ্ট। জাতীয় দলের এই খেলোয়াড় মাতৃত্বের স্বাদ নিতে যাচ্ছে তার চিকিৎসা এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার সাথে জড়িতদের এই বধোদয়টা থাকা বিশেষ জরুরী ছিল। গ্রামের অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত পরিবার তো আর সেই ভাবে সতর্ক ও সচেতন ছিল না। এ দায় কার? অজ পাড়া গায় হতে নিজেকে মেলে ধরা রাজিয়া বাংলাদেশের সাফ অনুর্ধ্ব ১৮এর দলের অন্যতম সাফল্যের কারিগর। ২০১৮ সালে ভুটানে অনুষ্ঠিত ঐ খেলায় বাংলাদেশ অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে এবং দেশের ভৌগলিকতায় সাতক্ষীরার সন্তান রাজিয়ার নাম স্থান পায়। আমাদের রাজিয়া বিত্তবান ঘরের সন্তান ছিল না। গ্রামের কাদামাটিতে বেড়ে ওঠা অশৈশবের দুরন্তপনা যেমন তাকে স্পর্শ করেছিলো অনুরুপভাবে স্কুল পর্যায়ে খেলতে খেলতে দেশ সেরা মহিলা ফুটবলারের সম্মান তাকে স্পর্শ করে। গরীব ঘরের কন্যা রাজিয়ার ছোটবেলার সঙ্গী ছিল আর তাই বিলে মাঠে গরু চরানো ভাইয়ের সাথে সে যাতায়াত করতো আর এটাই ছিল গ্রামের সচারাচর রোজনামচা, খড়কুটোর বল তার অভিষেক ঘটায় তারপর স্কুল পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বঙ্গমাতা ফুটবল খেলায় অসাধারন নৈপুন্যতায় তাকে জেলা শহরে,বিভাগ তারপর জাতীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করে। দেশের বয়স ভিত্তিক জাতীয় পর্যায়ের অনুর্ধ্ব ১৪, ১০, ১৬, ১৮ ও ১৯ দলে অসাধারন খেলা খেলে তাক লাগিয়ে দেওয়া রাজিয়া দেশের হয়ে খেলেছেন বিশ্বের দেশে দেশে, কালিগঞ্জের লক্ষ্মীনাথ পুর গ্রামের কন্যা একে একে খেলেছেন প্রতিবেশী দেশ ভারতে, নেপাল, ভুটানে, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কায়। সাতক্ষীরাকে বার বার আলোকিত করা রাজিয়া কেবল আলোকিত অতীত স্মৃতি নয়, আগামী দিনের নারী ফুটবলারদের পথিকৃত। শিশু সন্তান জন্ম দেওয়ার বার ঘন্টা পর পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়া রাজিয়ার চলে যাওয়ায় সাতক্ষীরার বিশলক্ষাধীক মানুষ শোকাহত একসাথে সুচিকিৎসার না পাওয়ায় হতাশ, দুরন্ততাকে সঙ্গী করে বেড়ে ওঠা রাজিয়ার শেষ সময়টি কেটেছে অতি বেদনায়, অসহায়ত্বের মধ্য দিয়ে। দীর্ঘ রক্ত ক্ষরনে তার মৃত্যু হয়েছে কিন্তু রক্তক্ষরন রোধে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা কি রাজিয়াকে সঙ্গী করেনি এমন প্রশ্ন মুখে মুখে। সদা হাস্যেজ্জ্বল রাজিয়া সন্তান জন্ম দিয়ে আবারও মাঠে ফিরতে চেয়ে ছিলেন কিন্তু মৃত্যু নামক চিরন্তন সত্যটা তাকে সে সুযোগ আর দেইনি। রাজিয়ার অসচেতনতাকে দায়ী করার সুযোগ নেই। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তান জন্ম দিতে তাই ঘরোয়া পরিবেশ কেই বেছে নিয়েছিলেন কিন্তু সংশ্লিষ্টরা জাতীয় দলের খেলোয়াড়কে সন্তান প্রসবের উপযুক্ত পরিবেশ বিশেষ করে ডাক্তার ও নার্স এর উপস্থিতি নিশ্চিত না করে আতুড়ঘরে মায়ের উপস্থিতি আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় পরিপন্থী। পৃথিবীতে মায়ের উপর কোন স্বজন নেই যেমন সত্য অনুরুপ মাকে যে দক্ষ হতে হবে এবং বিষয় বিশেষজ্ঞ হতে হবে এক্ষেত্রে তা ছিল অনুপস্থিত। সব শেষ কথা রাজিয়া কেন এমন ভাবে অবহেলায়, চিকিৎসা বিহীনতায় হারিয়ে যাবে। সাতক্ষীরার মেয়ে রাজিয়া যে দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে পুরস্কার গ্রহন করে ছিলো যেমন ভাবে হেসেছিল সাতক্ষীরা, তার মৃত্যুতে, চিরতরে হারিয়ে যাওয়ায় সে অপেক্ষা অধিকতর কেঁদেছে, কাঁদছে সাতক্ষীরার জনসমাজ। রাজিয়া হারিয়ে গেলে বেঁচে থাকবে রাজিয়ার গৌরব গাঁথা সব আলেখ্য।