জি এম শাহনেওয়াজ ঢাকা থেকে ॥ আইনের মারপ্যাচে লাগামহীন ওষুধের দামে পিষ্ট মানুষ। নিম্ন-মধ্যবৃত্ত পরিবারের মাসিক ওষুধের খরচ সমন্বয় করতেই রীতিমতো হিমশিম অবস্থা। কিন্তু নটক নড়ছে না ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের। বলছেন, ত্রিশ বছর আগে জারি গেজেটে সীমাবদ্ধ থাকায় ওষুধ উৎপাদনকারী সংস্থাকে নিয়ন্ত্রনে আনতে পারছে না সরকার ও প্রশাসন। কারণ গেজেটেই নির্ধারিত আছে ১১৭টি জেনেরিক ওষুধের বাইরে মূল্য বাড়লে সেখানে হস্তক্ষেপ করতে অক্ষম সরকার। কিন্তু তথ্য-উপাত্ত বলছে, এর বাইরে ২৫ হাজার নানা প্রকার রোগের ওষুধ বাজারজাত করছেন কোম্পানীগুলো। যদি ওষুধের দামে লাগাম টানতে হয় তাহলে মান্ধাতার আমলের গেজেটে জরুরি সংশোধন প্রযোজন। কারণ মানুষের নিত্য-প্রয়োজনীয় যেসব ওষুধ দরকার হয় তার মধ্যে এন্টিবায়োটিক একটি। এর মধ্যে রয়েছে ব্যথাজনিত সমস্যা, হাড়ক্ষয় ও শরীরের আঘাতজনিত কারণে মানুষ সবচেয়ে বেশি খেয়ে থাকে। সব ধরণের কোম্পানির ওষুধ প্রকার ভেদে প্রতি পিচের দাম বেড়েছে ২ থেকে ১৫ টাকা। এর মধ্যে সেপ-৩, রকজিন, সেফ-৩ডিএস। ব্যথার ওষুধের মধ্যে ক্লাভসেভ ও সেভোটিল প্রতি পিচে বেড়েছে ১৫ টাকা। গত একবছর আগে যে ওষুধ পাওয়া যেতে ৪৫ টাকায় বর্তমানে তা ১৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৬০টাকায়। বিশেষ করে প্রাণ-সংহারী করোনার পার ওষুধের বাজার লাগামহীন হয়ে পড়ে। সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে হার্ডের ওষুধ, ব্যথার ওষুধ (এন্টিবায়োটিক), প্রেসারের ওষুধ ও গ্যাসের ওষুধ। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ও মূখপাত্র (সদ্য পিআরএল কর্মকর্তা) ডা. মো নুরুল আলম বলেন, ইচ্ছামতো ওষুধের দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আইনের কিছুটা জটিলতা রয়েছে। সরকার সরাসরি নিয়ন্ত্রন করতে পারে মানুষের জন্য অত্যাবশীয় ১১৭টি জেনেরিক ওষুধের। বাকি যে ২৫ হাজার জেনেরিকের ওষুধ রয়েছে সেগুলোকে সরকার সরাসরি নিয়ন্ত্রন বা হস্তক্ষেপ করতে পারে না। ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের প্রয়োজনীয় অন্যান্য ওষুধগুলো তাদের উৎপাদন খরচসহ নানা অনুষঙ্গিক যোগ করে তাদের মতো করে বাজারজাত করে। এজন্য শুধু দায়সারা দায়িত্ব এড়াতে সরকারকে ভ্যাট প্রদানের জন্য ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের আবেদন করে মূল্যের বৈধতা দিয়ে থাকে। ফলে ওই সব ওষুধের উপরে সরকারের বড় ধরণের কোন নিয়ন্ত্রন নেই। এটা এক ধরণের সেচ্ছাচারিতার শামিল। অভিজ্ঞ এই কর্মকর্তা বলেন, শুধু ভ্যাট প্রদানের মাধ্যমে যে ওষুধগুলোসহ সরকারের তদারকির সুযোগ রয়েছে এমন ওষুধের ক্ষেত্রে দাম বাড়ানোর জন্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর খোঁড়া কিছু যুক্তি রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম ডলারের সংকট ও মূল্য বৃদ্ধি এবং ওষুধের কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি ও যোগাযোগ খরচ বেড়ে যাওয়া। তিনি বলেন, মূল সমস্যা গেজেট। কারণ এর বাইরে সরকার কাজ করতে পারে না। আইন করে নিজেদের হাত বেঁধে রেখে দিয়েছে। এটা ছুটাতে হবে। তবে ভিন্নমত পোষণ করেছেন ওষুধ শিল্প সমিতির সাধারন সম্পাদক শফিউজ্জামান। তিনি বলেন, ওষুধের দাম যেভাবে বাড়ার কথা সেভাবে বাড়েনি। কারণ আগে ডলার ৮০-৮২ টাকা ছিল সেটি বেড়ে ১৩০ টাকা হয়েছে। এইখানেই বড় গ্যাপ তৈরি হয়েছে।। ওষুধের কাঁচামাল বিদেশ থেকে আনতে হয়। র-মেটারিয়ারে দাম বেড়েছে। প্রতি পিচ ওষুধের দাম ১০ টাকা বেড়েছে, এটাকে আপনি অস্বাভাবিক মনে করছেন কি না, জবাবে বলেন, ‘না’। এখনো কমই আছে। পরক্ষণেই বলেন, যদিও বাড়ে তা-ও কম। এই নেতা বলেন, ওষুধের দামসহ সমস্যা নিয়ে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ডিজির কাছে আবেদন করা হয়েছে। কোনো প্রতিকার পাওয়া যায় না। আবার নতুন মন্ত্রী দায়িত্ব নিয়েই বলেছেন, ওষুধের দাম কমাবেন। কিন্তু কিভাবে কমাবেন তা আমার বোধগম্য হয় না। কারণ র-মেটারিয়ালের দাম যদি ৪০ শতাংশ বাড়ে তাহলে আমরা ওষুধের দাম কমাবো কিভাবে। আপনি দাম বাড়েনি বলছেন, বাজারে ওষুধের দামে মানুষ পিষ্ট এমন প্রশ্নের জবাবে সমিতির সম্পাদক বলেন, কোনো অসাধু চক্র যদি বাড়ায় তাহলে আমরা কি করব। প্রাপ্ত তথ্যমতে, দেশের শীর্ষস্থানীয় ১০টি কোম্পানি মোট ওষুধের শতকরা ৪৫ শতাংশ উৎপাদন করে। এগুলো হলো, -স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, গ¬াক্সো, রেনেটা, ইনসেপটা, হেলথ কেয়ার, এসকেএফ, সেনডোজ ও ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক দু’বাজারেই বাংলাদেশি ওষুধের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশে ওষুধের অভ্যন্তরীণ বাজার ছিল প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা, বর্তমানে তা প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বলা যায় প্রতি বছর একশ কোটি টাকা বেড়েছে। বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্যারাসিটামল গ্রুপের ওষুধ যেটি মানুষের জ্বর, কর্দি-কাশিসহ তাৎক্ষণিক অসুস্থতায় মানুষ খেয়ে থাকে। গত একবছর আগে যে সিরাপ বিক্রি হয়েছে (নাপা-সিরাপ) ২০টাকায় তা বেড়ে বর্তমানে বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকায়। একইভাবে প্রতি নাপা ট্যাবলেট পাতা পাইকারি বাজারে ৭টা ও খুচরা বাজারে ৮টা দরে বর্তমানে বেড়ে সেটি যথাক্রমে ১০ টাকা ৫০পয়সা ও ১২ টাকায়। মানুষের সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় ভোগের গ্যাসের সমস্যায়। এই ওষুধের প্রতি পিচ বেড়েছে ১টাকা। সেকলো-২০ এমজি প্রতি পিচ ৫টাকার ওষুধ ৬টাকায় বিক্রি হচ্ছে এবং সারজেল-৪০এমজি ১০টাকার ওষুধ ১ টাকা বেড়ে ১১টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আবার কার্ডিয়াক ডিজিজের বিশেষ করে প্রেসারের ওষুধ প্রতি পিচ বেড়েছে ২টাকা। এর মধ্যে ওসাটিল ও এনজেলিক ওষুধ রয়েছে। আবার ব্যথার ওষুধ নেপক্সিন গ্রুপের নেপোএপ্লাস প্রতি পিচের দাম বেড়েছে ১৫ টাকা। রাজধানীর ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, মিরপুর, শাহবাগ, পুরানো পল্টনসহ বিভিন্ন এলাকায় ফার্মেসি ঘুরে বাজারদর যাচাই করে প্রকারভেদে দুই থেকে ১৫ টাকা বৃদ্ধির সত্যতা খুঁজে পাওয়া গেছে। দোকানীদের একটাই অভিযোগ, বাজারে ওষুধের মূল্য বৃদ্ধির কারণ হিসেবে জানান, ডলারের দাম বৃদ্ধি। এছাড়া কিছুদিন পর পর যদি সরকারের পক্ষ থেকে বাজার তদারকি করা হতো তাহলে প্রকৃত বৃদ্ধির কারণ আমরা জানতে পারতাম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক উপদেষ্টা প্রফেসার ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, ওষুধের দাম বৃদ্ধির কারণগুলোর মধ্যে যদি কাঁচামালের দাম বেড়ে যায় ও শুল্ক যদি বেশি বসায় তাহলে দাম বাড়তে পারে। কিন্তু সরকার যাদের ওষুধ আমদানির লাইসেন্স দিয়েছে তারা এখানে এনে ওষুধ প্রক্রিয়াজাতকরণ করছে সেই ব্যয়টা খুবই সামান্য। সতারং ওষুধের দাম স্তিতিশীল রাখা সম্ভব। এর জন্য দুইটি কাজ করতে হবে, একটি বাজার নিয়ন্ত্রনের জন্য যে ব্যবস্থা সেটা কার্যকর না এবং দ্বিতীয় আগের যে আইনকানুন আছে সেগুলো সাপিসিয়েন্ট না। ফলে ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের ইচ্ছামতো দাম বাড়ায়; কোনো নিয়ন্ত্রন নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক এই উপদেষ্টা বলেন, এখন যেটা দরকার সরকার যদি ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রন করতে চায়, তাহলে তাদের কিছু নীতিমালা ঠিক করতে হবে। ওই নীতিমালার মধ্যেই থাকবে, – কোম্পানিগুলো কখন কি কারণে ওষুধের দাম বাড়াবে এবং সেটি বাড়াতে গেলেও সরকারের অনুমতি লাগবে। নিজেরা ইচ্ছা করলেই দাম বাড়াতে পারবে না। বলেন, সরকারের দেখার দায়িত্ব ওষুধ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকে কি না, কারণ জাতির স্বাস্থ্য নির্ভর করছে এটার উপরে। আর ওষুধ কোম্পানিগুলো যে পরিমাণ লাভ করে সেটার কোনো সীমা নেই। তাছাড়া তারা কিছু কিছু কাজ করে যেগুলোর কারণে দাম তাদের বাড়াতে হয়। এর মধ্যে চিকিৎসককে উপঢৌকন দেয়া অনৈতিক। সুতরাং অনৈতিক পন্থায় যারা ব্যবসা করতে চায় কখন সাধারণ কারণেই দাম বাড়াতে হয়। তা নাহলে তারা খরচ পোষাতে পারবে না। এখন সরকারের যেটা উচিত হবে, -জনগণের স্বার্থ দেখা।