এফএনএস : হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে সেখানে অন্য রোগ দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার ঘটনা ঘটছে অহরহই। মূলত দেশের সব হাসপাতালেই লেগে থাকে স্বজনদের ভিড়। রোগী দেখতে এসেও কেউ কেউ নতুন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। আবার অনেকে রোগীর সেবা করতে গিয়েও রোগীর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছেন। হাসপাতালে সংক্রমণ প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা না থাকায় ছড়িয়ে থাকা জীবাণুতেও আক্রান্ত হচ্ছেন রোগী কিংবা তার স্বজনরা। এক রোগ নিয়ে চিকিৎসা করাতে এসে আরেক রোগ নিয়ে ফেরা রোগীর সংখ্যাও কম নয়। এ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, বিশেষায়িতসহ দেশের শীর্ষ পর্যায়ের ৬০ শতাংশ হাসপাতালে সংক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল। প্রতিটি হাসপাতালে একটি দুর্বল সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ (আইপিসি) কমিটি রাখার নিয়ম আছে। যদিও অনেক হাসপাতালে কমিটির অস্তিত্ব মেলেনি। তাই হাসপাতালেই বিভিন্ন রোগ সংক্রমণের ঘটনা ঘটছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মতে, এই ধরনের সংক্রমণের মধ্যে রয়েছে মূত্রনালির সংক্রমণ, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, সার্জারি বা জটিল রোগের অস্ত্রোপচারের পরের সংক্রমণ এবং নতুন মা ও নবজাতকদের মধ্যে সংক্রমণ। চিকিৎসকদের মতে, হাসপাতালে আসার পর রোগীরা যে সংক্রমণে আক্রান্ত হন, সেটা পরে মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। কারণ, প্রাথমিকভাবে যে অসুস্থতার কারণে তারা হাসপাতালে আসেন, সেটার জন্য তারা মারা যান না। কিন্তু, হাসপাতালে আসার পরের সংক্রমণে তারা মারাও যান। সম্প্রতি ছয়জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের একটি দল দেশের সরকারি-বেসরকারি ও করপোরেট ৩৭টি হাসপাতালের সংক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে একটি গবেষণা করেন। এর মধ্যে ১১টি সরকারি ও ১১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, ১১টি জাতীয় ইনস্টিটিউট ও চারটি করপোরেট হাসপাতাল। গবেষণায় উঠে এসেছে, ৩৭টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৫টিতে (৪০ শতাংশ) আইপিসি বেশি পর্যায়ে কিংবা কমিটিই নেই। অন্য ৯টি প্রতিষ্ঠানে (২৪ দশমিক ৩২ শতাংশ) অপর্যাপ্ত বা কমিটি আছে কিন্তু বাস্তবে কার্যক্রম নেই। ৭টিতে (১৮ দশমিক ৯১ শতাংশ) আইপিসি ব্যবস্থা মাঝারি পর্যায়ের বা কমিটি আছে এবং কিছু কাজ হয়। দুটি সরকারি মেডিকেল কলেজ ও চারটি করপোরেট হাসপাতালে উন্নতমানের আইপিসি কন্ট্রোল করা হয় বা কমিটি এবং এর কার্যকারিতা রয়েছে। গবেষণা প্রসঙ্গে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মনজুরুল হক বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্নের ওপর ভিত্তি করে এ গবেষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল হাসপাতালগুলোতে আইপিসি চলমান আছে কি না বা সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে কি না। আমরা এতে দেখতে পাই বেশিরভাগ হাসপাতালেই আইপিসি কমিটি আছে। তবে কমিটির বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কার্যক্রম নেই। যেমন নিয়মিত মিটিং করা, তদারকি করা হয় না। এছাড়া জরিপে উঠে আসে, সরকারি হাসপাতালগুলোতে যে ধরনের সংক্রমণ বেশি ঘটছে সেগুলোর স্ক্রিনিংয়ে প্রচুর ঘাটতি রয়েছে। হেলথ কেয়ারে নিয়োজিতদের ট্রেনিংয়েও ঘাটতি। এছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক কীভাবে ব্যবহার করা হবে এর একটি গাইডলাইন আছে। তবে হাসপাতালগুলোতে তা সঠিকভাবে মানা হয় না। এছাড়া চার ভাগের এক ভাগ হাসপাতালে হাত পরিষ্কার করার স্থান নেই। জনশক্তির ঘাটতি অনেক বেশি। ডব্লিউএইচওর স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী যতগুলো বেড ততগুলো রোগী থাকবে, কিন্তু সরকারি শতভাগ হাসপাতালে বেডের চেয়েও অনেক বেশি রোগী ভর্তি থাকে। ডা. মনজুরুল হক বলেন, নোংরা পরিবেশ, অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও অপরিচ্ছন্ন টয়লেট -সরকারি হাসপাতাল নিয়ে এমন অভিযোগ নতুন নয়। এসবের কারণে হাসপাতালেই সংক্রমণের ঘটনা ঘটছে। ডা. মনজুরুল হক বলেন, ইনফেকশন প্রিভেনশন কন্ট্রোল বিষয়টি সঠিকভাবে পরিচালিত না হলে হাসপাতাল থেকে সংক্রমণ বেড়ে যাবে। হাসপাতালের সংক্রমণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অনেক বিপজ্জনক হয়। জীবাণুগুলো অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধক হয়। একজন রোগী বাড়িতে থেকে ইনফেকটেড হলে যে পরিমাণ ক্ষতি হয় তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হাসপাতালে এসে সংক্রমিত হলে। মৃত্যুর ঝুঁকিও বেড়ে যাবে। ডা. মনজুরুল হক বলেন, আমাদের ফুল টাইম আইপিসি প্রফেশনাল লাগবে। যেসব জায়গায় আইপিসি কমিটি নেই সেখানে আইপিসি কমিটি করতে হবে। যেখানে কমিটি থাকলেও কাজ হয় না সেখানে কার্যক্রম বাড়াতে বলা হয়েছে। গাইডলাইন (ওয়াশ ম্যানেজমেন্ট, অ্যান্টিবায়োটিক গাইডলাইন ইত্যাদি) মেনে চলতে হবে। আইপিসি রিলেটেড ট্রেনিং বাড়াতে হবে। এছাড়া মনিটর করার জন্য আলাদা লোক লাগবে। আইপিসির জন্য ডেডিকেটেড কোনো লোক নেই জানিয়ে তিনি বলেন, আইপিসির যারা কাজ করেন তারা বেশিরভাগই অন্য নানা কাজে যুক্ত। নির্দিষ্টভাবে আইপিসি তদারকির জন্য কোনো লোক নেই। উল্লেখ্য, ল্যানসেটের একটি গবেষণায় দেখা যায়, প্রতিবছর বিশ্বের এক কোটি ৩৭ লাখ মানুষ মারা যায় সংক্রমণজনিত কারণে। এর বড় অংশ হাসপাতালে সংক্রমিত। অন্য আরেকটি গবেষণায় উঠে আসে, পশ্চিমা দেশগুলোতে এ ধরনের সংক্রমণ ৩ থেকে ৫ শতাংশ আর এশিয়ান দেশগুলোতে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। এর মানে যেসব দেশে আইপিসি ব্যবস্থা ভালো সেখানে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হওয়ার হার কম। এজন্য চিকিৎসাসেবা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের হাসপাতালগুলোতে আইপিসি কমিটি সক্রিয় করলে সংক্রমণ কমে আসবে।