এফএনএস : গত বছরের আগস্টে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করে সরকার। তবে শুরুতে সর্বজনীন পেনশনে মানুষের ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেলেও মাঝে নিবন্ধনে কিছুটা ধীরগতি আসে। তবে চলতি বছরের এপ্রিলে সর্বজনীন পেনশনে নিবন্ধন করে চাঁদা জমা দিয়েছে বিপুলসংখ্যক মানুষ। এক মাসেই প্রায় ৬০ হাজার মানুষ নিবন্ধন সম্পন্ন করেছে। এতে সর্বজনীন পেনশনে নিবন্ধনের সংখ্যা ১ লাখের মাইলফলক স্পর্শ করেছে। নিবন্ধন সম্পন্ন করে চাঁদা পরিশোধকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ১ হাজার ৩৩৮ জন। নিবন্ধন সম্পন্নকারীদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি দরিদ্র মানুষ, যাদের বার্ষিক আয় ৬০ হাজার টাকার কম। অপরদিকে সব থেকে কম নিবন্ধন করেছেন প্রবাসীরা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে। সূত্রে জানা যায়, সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নিবন্ধন সম্পন্ন করা ১ লাখ ১ হাজার ৩৩৮ জন ৫২ কোটি টাকার বেশি চাঁদা জমা দিয়েছেন। চাঁদা বাবদ জমা পড়া টাকা থেকে এরই মধ্যে প্রায় ৪২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। সম্পূর্ণ টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে ট্রেজারি বন্ডে। গত বছরের ১৭ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বজনীন পেনশন স্কিম উদ্বোধন করেন। এর পরপরই আবেদন শুরু হয়। সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর পর এরই মধ্যে ৮ মাস পার হয়েছে। আট মাস পরে এসে নিবন্ধন সম্পন্নকারীর সংখ্যা এক লাখ স্পর্শ করলো। এদিকে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে জমা পড়া চাঁদার টাকা বিনিয়োগের একটি নীতিমালা করার কথা থাকলেও এখনো তা চূড়ান্ত হয়নি। অবশ্য বিনিয়োগ নীতিমালা শিগগির চূড়ান্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন দায়িত্বশীলরা। প্রাথমিকভাবে প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা এবং সমতা- এ চার স্কিম নিয়ে সরকার সর্বজনীন পেনশন চালু করে। পরে সব স্ব-শাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা এবং তাদের অধীনস্থ অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য সর্বজনীন পেনশন স্কিমে ‘প্রত্যয় স্কিম’ নামে নতুন স্কিম চালু করার ঘোষণা দেওয়া হয়। আগামী ১ জুলাই থেকে এ স্কিম কার্যকর হবে। বর্তমানে চালু থাকা চার স্কিমে চাঁদা পরিশোধকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ৩৩৮ জন। তাদের জমা দেওয়া চাঁদার পরিমাণ ৫২ কোটি ৩৮ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকা। নিবন্ধন সম্পন্ন করে সব থেকে বেশি চাঁদা জমা দিয়েছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীরা। তাদের জন্য চালু করা প্রগতি স্কিমে এরই মধ্যে চাঁদা জমা পড়েছে ২৪ কোটি ২০ লাখ ৬ হাজার ৫০০ টাক। অর্থাৎ সর্বজনীন পেনশনে এখন পর্যন্ত যে চাঁদা জমা পড়েছে তার ৪৬ দশমিক ২০ শতাংশ জমা দিয়েছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীরা। এ স্কিমে নিবন্ধনকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৭৮৪ জন। অপরদিকে, সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নিবন্ধনকারীদের মধ্যে সব থেকে বেশি দরিদ্র মানুষ, যাদের বর্তমান আয় সীমা বাৎসরিক সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা। এ শ্রেণির মানুষের জন্য চালু হয়েছে সমতা স্কিম। এ স্কিমে চাঁদা দিয়েছেন ৫৪ হাজার ৪৫৫ জন। তাদের জমা দেওয়া চাঁদার পরিমাণ ৭ কোটি ২৮ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। অর্থাৎ সর্বজনীন পেনশনে নিবন্ধনকারীদের ৫৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ দরিদ্র মানুষ। এ স্কিমের মাসিক চাঁদার হার ১ হাজার টাকা। এর মধ্যে স্কিম গ্রহণকারী চাঁদা দেবেন ৫০০ এবং বাকি ৫০০ টাকা দেবে সরকার। চাঁদা দেওয়া এবং নিবন্ধন করা দুদিক থেকেই সবার নিচে রয়েছেন প্রবাসীরা। বিদেশে অবস্থান করা প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য চালু করা হয়েছে প্রবাস স্কিম। এ স্কিম গ্রহণ করে চাঁদা দিয়েছেন ৬৩৩ জন। তাদের জমা দেওয়া চাঁদার পরিমাণ ৩ কোটি ৫ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকা। অর্থাৎ নিবন্ধনকারীদের মাত্র দশমিক ৬২ শতাংশ প্রবাসী। আর মোট জমা পড়া চাঁদার ৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ এসেছে প্রবাসীদের কাছ থেকে। চাঁদা দেওয়ার ক্ষেত্রে তৃতীয় স্থানে রয়েছেন- অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত বা স্বকর্মে নিয়োজিত ব্যক্তি যেমন- কৃষক, রিকশাচালক, শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতি ইত্যাদি পেশার ব্যক্তিরা। তাদের জন্য চালু করা হয়েছে সুরক্ষা স্কিম। এ স্কিম গ্রহণ করে চাঁদা পরিশোধ করেছেন ৩১ হাজার ৪৬৬ জন। তাদের জমা দেওয়া চাঁদার পরিমাণ ১৭ কোটি ৮৪ লাখ ৩৪ হাজার ৫০০ টাকা। অর্থাৎ মোট চাঁদার ৩৪ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ এসেছে এ স্কিমের মাধ্যমে। জমা পড়া চাঁদার টাকা বিনিয়োগের পরিমাণ এবং বিনিয়োগ নীতিমালার বিষয়ে সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা বলেন, ট্রেজারি বন্ডে এরই মধ্যে আমরা প্রায় ৪২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছি। বিনিয়োগ নীতিমালা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। আশাকরি শিগগির বিনিয়োগ নীতিমালা চূড়ান্ত করে প্রকাশ করা হবে। সমতা স্কিমে সব থেকে বেশি নিবন্ধনের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এ মুহূর্তে সমতা স্কিমে সব থেকে বেশি মানুষ নিবন্ধন করেছেন। হয় তো সমতা স্কিমের আওতায় যারা তাদের মধ্যে মেসেজটা গেছে, তাই তারা এসেছে। আর প্রগতি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আসবে, হয়তো তারা প্রিপারেশনে সময় নিচ্ছে। সময় মতো সবাই আসবে। হয়তো এক সময় প্রগতি বেশি হবে, এক সময় সুরক্ষা বেশি হবে। যে শ্রেণির মানুষ বেশি আসবে সেটাই বেশি হবে। প্রবাসীদের চাঁদা দেওয়ার পদ্ধতি সহজ করা হলেও নিবন্ধন কম হওয়ার কারণ কি? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমরা প্রবাসীদের চাঁদা দেওয়ার পদ্ধতি সহজ করে দিয়েছি। যে অ্যাকাউন্টে সে দেশে টাকা পাঠায়, সেই অ্যাকাউন্টে সে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে চাঁদার টাকা দিতে পারবে। এখন প্রবাসীদের নিবন্ধনের সংখ্যা কম। আমাদের সার্বিক নিবন্ধনের সংখ্যাও কম ছিল। এপ্রিল মাসেই প্রায় ৬০ হাজার মানুষ নিবন্ধন করেছেন। আশাকরি, প্রবাসীদের সংখ্যাও বাড়বে। কারণ প্রবাসীরাও বুঝবেন তাদের দেশে ফিরে যেতে গেলে আর্থিক, সামাজিক নিরাপত্তা লাগবে। সর্বজনীন পেনশন স্কিমে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী একজন সুবিধাভোগী ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত এবং ৫০ বছরের ঊর্ধ্ব বয়স্ক একজন সুবিধাভোগী ন্যূনতম ১০ বছর চাঁদা দিয়ে আজীবন পেনশন সুবিধা ভোগ করবেন। পেনশনে থাকাকালীন ৭৫ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগে মারা গেলে পেনশনারের নমিনি পেনশন স্কিম গ্রহণকারীর ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার অবশিষ্ট সময় পর্যন্ত পেনশন পাবেন। চাঁদাদাতা কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার আগে মারা গেলে জমা করা অর্থ মুনাফাসহ তা নমিনিকে ফেরত দেওয়া হবে। চাঁদাদাতার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কেবল তার জমা করা অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসাবে উত্তোলন করা যাবে। এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, সর্বজনীন পেনশনকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে মাঠ প্রশাসনকে সক্রিয়ভাবে যুক্ত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মাধ্যমে জাতীয়, বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ‘সর্বজনীন পেনশন কার্যক্রম বাস্তবায়ন ও সমন্বয় কমিটি’ গঠন করা হয়েছে এবং মাঠ প্রশাসনকে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের বিভাগভিত্তিক মনিটরিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলশ্রুতিতে, কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসাররা (ইউএনও) নিয়মিতভাবে বিভাগ, জেলা ও উপজেলাভিত্তিক নিবন্ধন মনিটরিং ও বাস্তবায়ন করছেন। বিভাগীয় পর্যায়ে সর্বজনীন পেনশন মেলা ও কর্মশালার আয়োজন করে সব শ্রেণি-পেশার জনগণকে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে গত ১৯ এপ্রিল রাজশাহীতে বিভাগীয় পেনশন মেলা ও কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরবর্তীতে অবশিষ্ট সাত বিভাগে বিভাগীয় মেলা অনুষ্ঠিত হবে। বিতরণের জন্য মাঠ প্রশাসনের কাছে এরই মধ্যে পর্যাপ্ত সংখ্যক ফ্লায়ার বুকলেট পাঠানো হয়েছে এবং তা অব্যাহত আছে। এছাড়া সর্বজনীন পেনশন কার্যক্রমে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার উদ্যোক্তাদের সম্পৃক্ত করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।