এম এম নুর আলম \ আশাশুনি উপজেলার বিভিন্ন এলাকার সুপেয় পানির অন্যতম উৎস হচ্ছে বৃষ্টি। কিন্তু গত কয়েকমাস এ অঞ্চলে বৃষ্টির দেখা মেলেনি। দুর্যোগপূর্ণ পরিবেশ, লবণ পানির প্রভাব, সুপেয় পানির উৎস না থাকার কারণে এসব অঞ্চলের মানুষ এখন খাবার পানির চরম সংকটের মধ্যে রয়েছে। আশাশুনি উপজেলার আশাশুনি সদর, শ্রীউলা, প্রতাপনগর, খাজরা, আনুলিয়া, কুল্যা, কাদাকাটি ইউনিয়নসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে সুপেয় পানির চরম সংকট চলছে। পানি সংগ্রহের জন্য স্থানীয়দের পাড়ি দিতে হচ্ছে দীর্ঘপথ। এসব এলাকার কয়েক লাখ মানুষ কমবেশি খাবার পানির সংকটে রয়েছে। এক কলস পানি সংগ্রহের জন্য মহিলা ও শিশুরা ছুটে যান এক গ্রাম থেকে অন্যগ্রামে। কোনো কোনো গ্রামে মিষ্টি পানির আধার বলতে আছে ২-১টি পুকুর। বিভিন্ন এলাকার কয়েকজন গৃহিনী দৃষ্টিপাতকে জানান, “পানির জন্য বর্ষার আশায় আমরা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। বর্ষাকাল যেন দীর্ঘস্থায়ী হয়, আমরা আলাহর কাছে প্রার্থনা করি। বছরের ১২ মাসের মধ্যে বর্ষাকালের ৩-৪ মাস ভালো পানি পাই। বাকি সময়টুকু খাবার পানির তীব্র সংকট থাকে। ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পানির আধারগুলো অনেক দূরে থাকার ফলে পানির জন্য টিকে থাকার লড়াই আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।” তারা আরও জানান, ঘরের সব কাজ শেষে বিকেলে পানি সংগ্রহে বের হতে হয়। ওই দুই কলসি পানি দিয়েই পরদিন সব কাজ করতে হয়। শুধু এটুকু পানি সংগ্রহ করতে ২/৩ ঘণ্টারও বেশি সময় ব্যয় করতে হয়। এভাবেই আমরা পানির জন্য লড়াই করছি বছরের পর বছর। সচেতন মহল জানান, জলবায়ু পরিবর্তন আর পরিবেশগত নানা সমস্যায় আশাশুনির বিভিন্ন এলাকায় লবণাক্ততা বাড়ছে। আইলার আগে এই এলাকায় এতটা পানির সংকট ছিল না। কিন্তু আইলা, আম্পানসহ বিভিন্ন প্রলয়ে সুপেয় পানির অনেক আধার লবণ পানিতে ডুবে যায়। ফলে মিঠা পানির সংকট দিন দিন বাড়ছে। তারা আরও জানান, একফোঁটা পানির মূল্য অনেক। নারী-পুরুষ ও শিশুরা পায়ে হেঁটে পানি আনেন, আবার কখনো ড্রাম ভরে ভ্যানে করেও আনেন। এতে পানির মূল্যটা আরও বেড়ে যায়। আশাশুনির বিভিন্ন এলাকায় ঠিক পাঁচ বছর আগে যেমন পানির কষ্ট ছিল, এখন সেই সংকট আরও কয়েকগুণ বেড়েছে। সংকট সমাধানে উদ্যোগের শেষ নেই। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নেওয়া হয়েছে নানান পদক্ষেপ। তবে পানির কষ্ট খুব একটা লাঘব হয়নি। ঘরের সবদিকে পানি। অথচ খাবারের পানির জন্য যুদ্ধ করতে হয়।” স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানাগেছে, তাদের এলাকায় খাবার জন্য মানুষ বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে। কিন্তু বড় ট্যাংকির অভাবে অনেক পরিবারের পক্ষে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা সম্ভব হয় না। তবে এবার উপজেলার বিভিন্ন ওয়ার্ডে পরিবার পর্যায়ে ইউএনডিপি’র একটি প্রকল্পের মাধ্যমে বড় ট্যাংকি বসানো হয়েছে। “জলবায়ু পরিবর্তন ও লবণাক্ত এলাকা স¤প্রসারণের পরিপ্রেক্ষিতে সুপেয় পানির সন্ধানে” শীর্ষক এক সেমিনারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ পশ্চিম উপকূল এলাকায় লবণাক্ততার পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ জলাধারের বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে। এ এলাকার অবস্থান ব-দ্বীপের নিম্নাংশ। ফলে নদী বাহিত পলির আধিক্য বেশি। একারণে ভূগর্ভে জলাধারের জন্য উপযুক্ত মোটা দানার বালু বা পলির স্তর খুব কম পাওয়া যায়। আর পলির স্তর পাওয়া গেলেও এই বালুর স্তরের পুরুত্ব খুবই কম। আর কোথাও কোথাও এই বালুর স্তরের ভূমি থেকে অনেক গভীরে। সেখান থেকে মিষ্টি পানি উত্তোলন অত্যন্ত দুরূহ।” পানি কমিটির পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, বাংলাদেশের গভীর নলকূপগুলো সাধারণত ৩০০ থেকে ১২০০ ফুটের মধ্যে হয়। দেশের উত্তরাঞ্চলের ৩০০ থেকে ৪০০ ফুটের মধ্যে গভীর নলকূপ বসানো যায়। কিন্তু দেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় এলাকায় এই নলকূপের গভীরতা ৭০০ থেকে ১২০০ ফুটের মধ্যে। এ সকল নলকূপের পানি তূলনামূলক কম লবণাক্ত এবং আর্সেনিকমুক্ত। তবে পলি মাটির আধিক্য এবং অধিক লবণাক্ততার কারণে উপকূলীয় সব এলাকার গভীর নলকূপ স্থাপন করা সম্ভব হয় না। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানাগেছে, এসব এলাকার পানি সমস্যা সমাধানে ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে এবং এই পানি প্রতিটি পরিবারের জন্য সহজলভ্য করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।