কয়রা (খুলনা) প্রতিনিধি ॥ ভোর থেকেই মেঘলা আকাশ, গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। আর বৃষ্টি মানেই এখন জনজীবনে ভোগান্তি। তবে বৃষ্টির দেখা পেয়েই রাস্তা দিয়ে পিঠে মোটা ব্যাগ নিয়ে ও—– ছাতি সারাই করবেন ছাতি সারাই এমন চিৎকার করে বাড়ী বাড়ী ঘুরতে দেখা গেল ছাতা মেরামত কারিদের। বৃষ্টির মৌসুমে একটু কাজ ভাল হয়। তখন দৈনিক ৫ শত থেকে ৬ শত টাকা পর্যন্ত আয় করছি। তয় এহন আর ছাতি মেরামতের কাজে আগের মতো পয়সা নাই। এখন দিনে দুইশত থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত পাই। খালি ছাতি মেরামত কইরা না, খালি গ্যাসলাইটে গ্যাস ভইরাও কিছু টাকা পাই। কিন্তু এই আয়েও সংসার চলে না। বাজারে সব কিছুর দাম বেশি। আমাগো মতোন গরিবের পক্ষে এতো দাম দিয়া কিন্না খাইতে কষ্ট অইয়া যায়। মাছ – গোশত তো চাইলেই জোডে না। হ্যার মধ্যে আবার মাস শ্যাসে ছেলেমেয়েদের পড়ার খরচ দেতে হয়। আমাগো সংসার এখন আল্লায় চালায়। এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন ৬৫ উর্ধ্ব বয়সী আবুল হাসান। উপজেলার মহারাজপুর গ্রামের রাস্তার পাশে কাগজ বিছিয়ে ছাতা মেরামত করছিলেন তিনি। ভাঙা ছাতা ঠিক করেই সংসার চলে তার। আবুল হাসান বলেন, বৃষ্টি হলেই ছাতা মেরামতের জন্য গ্রাহকের সংখ্যা বাড়ে। নতুবা তেমন একটা আয় হয় না। বৃষ্টি থাকলে এক জায়গাই বসে থাকলেই গ্রাহকের সংখ্যা বাড়তে থাকে দিনে ২০ থেকে ৩০ জন গ্রাহকের কাছ থেকে ৭/৮শত টাকা আয় করতে পারি। আর বৃষ্টি না হলে ছাতা মেরামতের জন্য মানুষের ঘরে ঘরে যেতে হয়। ৫০০ টাকাও আয় করতে পারি। বর্ষা মৌসুম মানুষ ছাতা মেরামত করতে আসলেও অন্য সময়ে তেমন একট আসে না। তাই বৃষ্টি হলে আমাদের একটু আয় বাড়ে। আবুল হাসানের কাছে ছাতা মেরামত করতে আসা মরিয়মও ভাঙা ছাতা ঠিক করতে এসেছিলেন। তিনি জানান, বাসায় থাকায় তিনটি ছাতার মধ্যে দুটোই নষ্ট হওয়ায় ঠিক করতে নিয়ে এলাম। একটি শিক ঠিক করতে নিচ্ছেন ৪০ টাকা থেকে ৫০ টাকা। আর শিকের সাথে লাগানো কাপড় সেলাই করতে ১০ থেকে ২০ টাকা এবং ছাতার বিভিন্ন অংশ ঠিক করতে নিচ্ছেন ৬০ থেকে ৭০ টাকা। তবুও অনেক ভাল। কেননা এ মহুর্তে নতুন ছাতা কেনা সম্ভব না। এক সময় হাট-বাজারে ছাতা মেরামত কারিগরদেও দেখা মিললেও এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। চাহিদা না থাকায় অনেকেই ছেড়ে দিয়েছেন এই আদি পেশা। অনেকে আবার ছাতা মেরামত করার পাশাপাশি একই সঙ্গে অন্য পেশায় যুক্ত হয়েছেন। কালের বিবর্তনে কমছে এ পেশায় লোকজনের সংখ্যা। ছাতা মেরামত কারিগর বলেন, এক সময় মানুষ প্রচুর পরিমাণে ছাতা ব্যবহার করতো। কিন্তু এখন মানুষ আর আগের মতো ছাতা ব্যবহার করে না। আগে মানুষ পায়ে হেঁটে বেশি যাতায়াত করতো। তাই রোদ বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে ছাতা ছিল তাদের একমাত্র সম্বল। কিন্তু মানুষ এখন গাড়িতে চড়ে বেশি যাতায়াত করে। তাই রোদ বৃষ্টি থেকে বাঁচতে গাড়ীর মধ্যে আর ছাতা প্রয়োজন হয় না। তাই এখন খুব কম মানুষই ছাতা ব্যবহার করে। এছাড়া ওয়ান টাইম ইউজ চায়না ছাতা বের হয়েছে দামে খুব কম। ছাতা নষ্ট হলে মানুষ এখন ফেলে দেয়, আর ঠিক করে না। তাছাড়া মানুষের আয় এখন বেড়েছে তাই ছাতা নষ্ট হয়ে গেলে তারা ফেলে দেয়, ঠিক করে না। ছাতার বাজার চায়না ও ভারতের দখলে গেছে । তাই কাঠের ছাতার কারিগরদের দুর্দিন চলছে। ছাতা মেরামতকারী মুসা বলেন, বর্তমানে ছাতা মেরামত করে আমার আয় সামান্য। ছাতার শিক লাগাই। কাপড় সেট করি। এছাড়া সাধারণ মানুষ ছাতা মেরামতের জন্য নিয়ে আসেন। তাদের ছাতা মেরামত করে দৈনিক ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত আয় হয়। এ টাকায় সংসার চলে না। পিতৃ পুরুষের এ পেশা ছাড়তেও পারি না। আক্ষেপের সুরে আঃ রহিম বলেন, হুনছি সরকার বয়স্ক মানুষের বয়স্ক ভাতা দেয়, চাউল দেয়। কিন্তু আমাগো ভাগ্যে হেডাও জোডে না। রাস্তার পাশে বইয়া ছাতি সারাই করে চলছে সংসার। মেয়ে বিয়ে দিছি, সে শশুর বাড়ী থাহে। একমাত্র ছেলে খুলনায় অটোরিকসা চালায়। কিন্তু আমাগো খোঁজ খবর লয় না। তার পরেও চাই স্ত্রী সন্তান নিয়ে হ্যারা ভাল থাকুক। আমাগো তো দিন শ্যাস এহন শান্তিতে মরতে পারইে হয়। শুধু রহিম নন, তার মতো আরো অনেকেই সংগ্রাম করে জীবন যুদ্ধে টিকে আছেন। কিন্তু এসব মানুষের খোঁজ নেয়ার সদিচ্ছাও দেখান না কেউ।