# ছাত্রলীগ নেত্রী কৃষি সচিব ওয়াহিদার দাপট
ঢাকা ব্যুরো ॥ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহে (বাকৃবি) ছিলেন ছাত্রলীগ নেত্রী। ছাত্রজীবন শেষে ১৩তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দেন ওয়াহিদা আক্তার। এক প্রতিমন্ত্রীর পিএস থেকে হন প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের পরিচালক। এরপর প্রধানমন্ত্রীর পিএস হিসেবে কাটান প্রায় চার বছর। সেখান থেকে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে যোগ দেন কৃষি মন্ত্রণালয়ে। ছাত্রলীগ ব্যাক গ্রাউন্ড থাকায় অতিরিক্ত সচিব থেকেও সচিবের পাওয়ারে ছিলেন ওয়াহিদা। সচিব পদে পদোন্নতির পর কৃষিতেই থেকে যান তিনি। চলতি বছরের মার্চ মাসে অবসরে যাওয়ার পর দলীয় কোটায় এক বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান তিনি। গত কয়েক বছর ধরে কৃষি সেক্টরের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল এই আমলার। শেখ হাসিনার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের খাতিরে দলীয় কার্যক্রমেও অংশগ্রহণ করেন। প্রতিটি বক্তৃতায় মন্ত্রী-এমপিদের ভাষায় রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা দিয়েছেন অধস্তন কর্মকর্তাদের। গত রবিববার চলমান আন্দোলনের মধ্যেই সরকারি কৃষিবিদ কর্মকর্তাদের মাঠে নামান এই কর্মকর্তা। তার পিএস এবং তিনি নিজে খামারবাড়ি ও মানিকনগরে বঙ্গবন্ধু কৃষিবিদ পরিষদের কথিত শান্তি সমাবেশে যোগ দেন। শুধু তা-ই নয়, তার স্বামী ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার সচিব পদ মর্যাদায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান। অনেক সিনিয়রকে ডিঙিয়ে বখতিয়ারকে চেয়ারম্যান বানান ওয়াহিদা। শুধু তা-ই নয়, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে সম্পর্কের সূত্র ধরে দুইবার স্বামীকেও চুক্তিভিত্তিক রেখেছেন। সংশি¬ষ্টরা বলছেন, গত কয়েক বছরে স্বামী-স্ত্রী মিলে কৃষি সেক্টরকে কব্জায় নেন। অর্জন করেন কোটি কোটি টাকা। মেধাবী কর্মকর্তাদের জামায়াত-বিএনপির তকমা দিয়ে তাদের শাস্তিমূলক জায়গায় পদায়ন দিয়ে রেখেছেন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের ১৯টি অধিদফতর/সংস্থার পদগুলোতেও নিয়োগ হয়েছে দলীয় বিবেচনায়। ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ আন্দোলনে শেখ হাসিনার পালানোর পর কিছুদিন গ-ঢাকা দেন ওয়াহিদা আক্তার ও তার স্বামী শেখ বখতিয়ার। তবে, বঙ্গভবনে অন্তবর্তীকালিন সরকারের উপদেষ্টাদের শপথ অনুষ্ঠানে তাকে উপস্থিত থাকতে দেখা যায়। সেখানেই তিনি কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে আলাপে জানান, তার চাকুরি থাকবে না। তথ্যমতে, ছাত্রলীগ ব্যাক গ্রাউন্ডের পাশাপাশি ওয়াহিদা আক্তার শেখ হাসিনার উপদেষ্টা মশিউর রহমানে ভাগ্নি ছিলেন। আগামী নির্বাচনে খুলনা থেকে আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচন করারও পরিকল্পনা ছিল বলে তার ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য। এছাড়া কৃষি সচিব হওয়ার পর ওয়াহিদা আক্তারের ঘন ঘন বিদেশ সফর করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসেন। নথি অনুযায়ী, গত বছর ওয়াহিদা আক্তার ১১টি দেশ সফর করেছেন, যার মধ্যে মে থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে তিনি গেছেন ছয়টি দেশে। যা বিদেশ ভ্রমণ নিয়ে সরকারি নির্দেশনার স্পষ্ট লঙ্ঘন। ২০২৩ সালের মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি ছয় বার এবং ২০২৪ সালের জানুয়ারি-মে পর্যন্ত পাঁচ বার তিনি বিদেশ সফর করেছেন। ২০১১ সালের ১৯ জুন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ‘বিদেশ ভ্রমণের অনুমতি এবং অনুসরণীয় আনুষঙ্গিক বিষয়াদি’ শিরোনামে একটি সার্কুলার জারি করে, যেখানে বলা হয়েছে, একজন সচিব বছরে সর্বোচ্চ চার বার সরকারি কাজে বিদেশ ভ্রমণ করতে পারবেন। শুধু কৃষি মন্ত্রণালয় নয়, এভাবে সরকারের প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের সচিব, অতিরিক্ত সচিবসহ ক্যাডার অফিসারদের মধ্যে গত ১৬ বছরে একচেটিয়া আওয়ামীকরণ করা হয়েছে। বিশেষ করে গত ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের আগ মুহূর্তে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও দফতরে দলকানা কর্মকর্তাদের বসিয়ে রেখেছে আওয়ামী লীগ।
২০১৯ সালে আব্দুস সবুর মন্ডল নামে পাওয়াফুল এক কর্মকর্তার জন্য দীর্ঘ সময় ফেরি আটকিয়ে রাখার কারণে অসুস্থ এক শিশুর মৃত্যু ঘটে মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ঘাটে। সেই পাওয়ারফুল কর্মকর্তা এখন ভূমি আপিল বোর্ডের চেয়ারম্যান (সচিব)। কোনো এক এমপির মেয়ের জামাই হওয়ার কারণে ওই ঘটনায় পার পেয়ে যান। হন সচিবও। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন মো: জাহাঙ্গীর আলম। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার কৌশলে অন্যতম নিয়ামকের ভূমিকায় ছিলেন সাবেক এই ইসি সচিব। পরে নানা তদবির করে অনেক সিনিয়রকে ডিঙিয়ে তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে বসানো হয়েছে। নির্বাচন কমিশন সচিব হিসেবে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি বিতর্কিত নির্বাচনী বৈতরণী পার করান। জাতিকে একটি একদলীয় নির্বাচন ব্যবস্থায় নিতে তারও অবদান কম নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মেসবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী। স্বাস্থ্যসেবা সচিব জাহাঙ্গীর হোসেনও ছাত্রলীগার হিসেবে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর এপিএস। কর্মকর্তাদের মধ্যে তিনিও অত্যন্ত প্রতাপশালী হিসেবে পরিচিত। সরকারি কবি হিসেবে পরিচিত নবিরুল ইসলাম। তিনি এখন গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব। সরকারি কর্মকর্তাদের ‘জ্ঞানচর্চা ও পাঠ্যভ্যাস’ বাড়ানোর জন্য ৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় জন প্রশাসন মন্ত্রণালয়। ২০২২ সালে ওই মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব ছিলেন এই নবিরুল। তার স্ত্রী আমেনা বেগমও তখন একই মন্ত্রণালয়ের সংস্কার ও গবেষণা অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব। নবিরুল ইসলাম তার নিজের লেখা ২৯টি বই সরকারি কর্মকর্তাদের পড়ার তালিকায় রাখেন। যার বেশির ভাগই কবিতার বই। এ নিয়ে তখন দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। বিতর্কিত এই কর্মকর্তা দলীয় বিবেচনায় এখন গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব। আওয়ামী ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে শেখ হাসিনা সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখেন প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সচিব সালাহউদ্দিন। ১৩তম ব্যাচের এই কর্মকর্তা ছাত্রলীগারদের বেছে বেছে পদোন্নতি এবং ভালো জায়গায় পদায়নে ভূমিকা রাখেন।
এ ছাড়া নৌসচিব মোস্তফা কামাল, আইন সচিব মো: গোলাম সারোয়ার, স্থানীয় সরকার সচিব আবু হেনা মোর্শেদ জামান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মশিউর রহমান, জ্বালানি সচিব নুরুল আলম, পেট্রো বাংলার চেয়ারম্যান আমিনুল আহসান, পরিকল্পনা বিভাগের সচিব সত্যজিত কর্মকার, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এ কে এম শামিমুল হক সিদ্দিকী, নির্বাচন কমিশন সচিব শফিউল আজিম রয়েছেন এ তালিকায়। এদের কেউ আওয়ামী লীগার হিসেবে আবার কেউ সুবিধাবাদী হিসেবে দাপট দেখিয়ে আসছেন প্রশাসনে। যাদের মধ্যে অনেকে আছেন অবৈধ উপায়ে কোটি কোটি টাকা অর্জন করেন। বর্তমান সরকারের আমলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হয়েছেন আব্দুর রউফ তালুকদার। আওয়ামী ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকলেও সুবিধাবাদী হিসেবে শেখ হাসিনার একান্ত অনুগত হিসেবে পরিচিত। ইতিমধ্যে এই কর্মকর্তা পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। একইভাবে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা রহমাতুল মুনিমসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রধান রয়েছেন আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ। তিনিও পদত্যাগ কেেছন। চাকরির মেয়াদ শেষে চুক্তিভিত্তিক রয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো: মাহবুব হোসেন ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া। তবে মূখ্যসচিব চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল হয়েছে। একান্ত দলীয় হিসেবেই তাদের চুক্তিতে রাখেন হাসিনা সরকার। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, শুধু সচিব পদ মর্যাদার কর্মকর্তাই নন, প্রশাসন ক্যাডারের নিম্ন পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যন্ত দলীয়করণ করে গেছেন শেখ হাসিনা। উপসচিব, যুগ্মসচিব এবং অতিরিক্ত সচিবদের অনেকে যতটা না আমলা, তার চেয়ে বেশি দলীয় কর্মীর ভূমিকায় রয়েছেন। বিশেষ করে হাসিনা সরকারের মন্ত্রী ও সচিবদের বেশির ভাগ পিএসরা দলীয় ক্যাডারের ভূমিকায় ছিলেন।
বিভিন্ন সূত্রের খবর, এসব কর্মকর্তা-কর্মচারিরা অবৈধ উপায়ে নামে-বেনামে অনেকে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। নিজ পরিবারের নিরাপত্তা ও সম্পদ রক্ষায় আওয়ামী লীগার ও সুবিধাভোগী সরকারি কর্মকর্তারা এখন আতঙ্কের মধ্যে পড়েছেন।