জি এম শাহনেওয়াজ ঢাকা থেকে ॥ প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশ সচিবালয়। রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনে বঞ্চিত একটি পক্ষ ফ্রন্টলাইনে ফেরায় জন-প্রশাসন মন্ত্রণালয় ফের সরগরম। এটা গত কয়েকদিনের কমন চরিত্র। উল্টো দীর্ঘদিন সরকারের সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তরা কিছুটা চাপে ও আতঙ্কে রয়েছেন। গতকাল রবিবার থেকে উর্দ্ধতনরা অফিস শুরু করলেও মানষিকভাবে চাঙা হতে পারেননি অনেক সিনিয়র সচিব ও সচিবগণ। নিজেদের অতিরঞ্জিত কর্মকান্ডের কারণে বঞ্চিতদের রোষানলে পড়তে পারেন এমন আশঙ্কায় চুপিচাপে মন্ত্রণালয়ে এসে নিজ কর্মকান্ডের মধ্যে থাকছেন সীমাবদ্ধ। তবে গত ৫ আগষ্টের পর গতকাল রবিবার আমলাদের উপস্থিতি বেশি দেখা গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন-নিরাপত্তা বিভাগের সচিব মো. জাহাংগীর আলম স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাদের সঙ্গে পট-পরিবর্তনের পর প্রথম দেখা যায়। তবে তাকে অনেক ম্লন দেখা যায়। এমনকি সাংবাদিকদের সঙ্গে যখন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা কথা বলছিলেন, এর আগেই তিনি সবাইকে এড়িয়ে নিজ কক্ষে চলে যান। সাংবাদিকদের কথার মধ্যে একবার জন-নিরাপত্তা সচিব এর নাম উচ্চারণ করেছিলেন উপদেষ্টা। এই উদ্ধুদ পরিস্থিতির মধ্যে দলীয় লেজুড়বৃত্তি বন্ধে শুরু হয়েছে প্রশাসনে শুদ্ধি অভিযান। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক-আইজিপি ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমডি) কমিশনারকে অব্যহতি দেয়া হয়েছে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে থাকা সিনিয়র সচিব-সচিব যারাই আছেন সাময়িক এ নিয়োগ বাতিল করা হচ্ছে। এর বাইরে যারা সরকারের আস্থাভাজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা আছেন পর্যায়ক্রমে তাদের ওএসডি করা হবে। আর সব যোগ্যতা থাকা সত্বেও সদ্য পদত্যাগী সরকারের বিরাজভাজন কর্মকর্তাদের যোগ্যতানুযায়ী পদোন্নতি ও পদায়ন দিয়ে প্রশাসনে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকবে। ইতিমধ্যে প্রশাসনের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ (এপিডি) অনুবিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন অতিরিক্ত সচিব মো. আব্দুর রউফ (এনডিসি)। এ পদে দায়িত্বে ছিলেন ১৫ ব্যাচের কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত সচিব নাজমুছ সাদাত সেলিম। পদত্যাগী সরকারের আস্থাভাজন হওয়ার কারণে তাকে ওএসডি করে জনপ্রশাসনে পদায়ন করা হয়। এমনকি যারা বিদায়ী সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গভবনে এবং বিভিন্ন সময়ে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে বিরোধীদের উপরে দমনপীড়ন করেছিল তাদের প্রতিও তীক্ষ্ন নজর রাখছে বর্তমান সরকার। তাদেরকেও গুরুত্বপুর্ণ জায়গা না বসাতে একট্টা দীর্ঘদিন পদোন্নতি-পদায়ন বঞ্চিত পুলিশ-প্রশাসনের একটি পক্ষ। এমনকি যারা মাঠে ডিসি ও এসপি রয়েছেন দ্রুতই তাদের বদলি করে নতুন ডিসি ও এসপি নিয়োগ করার প্রক্রিয়া শুরু করতে যাচ্ছে এপিডি উইং। এদিকে, আওয়ামী লীগ সরকারের আস্থাভাজন ও অনুসারী হওয়ার পরও দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও দুর্নীতির কারণে পদোন্নতি না পাওয়া একশ্রেণির সুযোগ-সন্ধানী কর্মকর্তা বঞ্চিতদের দলে ভিড়ে গেছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। তাদের পদোন্নতি না পাওয়াকে আগের সরকারের প্রতি আনুগত্য না দেখানোর কারণে বলে শুরু করেছেন মায়াকান্না। তবে বঞ্চিতদের একটি পক্ষ এ নিয়ে রয়েছেন সোচ্চার। ইতিমধ্যে প্রায় তিনশ কর্মকর্তার একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এদের মধ্যে থেকে সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি দিয়ে প্রশাসনে আগের সরকারের রেখে যাওয়া চক্রকে ওএসডি ও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর কৌশল নিয়ে কাজ করছে দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টারা। এতে সাপ-ও মরবে, লাঠিও ভাঙবে। এর আগে এসএসবির সভা করে যোগ্যদের মধ্যে থেকে সচিব ও অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হবে। সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দলীয় নাম-পরিচয়ে কে কখন কাকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে তা বোঝা দায়। টানা ১৫ বছরের ধারাবাহিকতায় চোরে চোরে মাসতুতু ভাই একটি পক্ষ সরকারের চেয়ে বড় সরকার হয়ে উঠে। এখন তাদের কৌশলে সাইট করে প্রশাসনকে নিরপেক্ষ করতে তৎপর বিএনপি-জামায়াত বলয়ের বঞ্চিতরা। কিন্তু সর্ষের মধ্যে ভূত ঢুকেছে বলে মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ। এমনিই একজন শ্রীনিবাস দেবনাথ। সরকারের উপসচিব পদমর্যাদার এই কর্মকর্তা ধর্ম মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন। ২০২১ সালে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ১৮০০ পদে নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। শতকোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগে পরপর তিনবার পদোন্নতি দেয়া হয়নি তাকে। ২০ ব্যাচের এই কর্মকর্তা সুযোগ বুঝে ঢুকে পড়েছেন বঞ্চিতদের তালিকায়। যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি প্রত্যাশী ১৫০ জন কর্মকর্তার তালিকায় এই কর্মকর্তা রয়েছেন ৮৪ নম্বরে। যদিও ১৫০ জনের এই তালিকা গতকাল পর্যন্ত বেড়ে ২৪৫ জনে ঠেকেছে বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। হাতে আসা ১৫০ জনের তালিকা বিশে¬ষণ করে দেখা গেছে, নিজেদের বঞ্চিত বলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পদোন্নতি দাবি করছেন এমন কর্মকর্তাদের মধ্যে একাধিক ব্যক্তি রয়েছেন যারা দুর্নীতিবাজ। যাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও হয়েছিল। কট্টর সমর্থক হওয়ার পরও শুধু দুর্নীতির কারণে পদোন্নতি দেয়নি আওয়ামী লীগ সরকার। সদ্য বিদায়ী সরকারের আমলে গুরুত্বপূর্ণ এবং লোভনীয় পদে পদায়ন ছিলেন এমন কর্মকর্তাও রয়েছেন এই তালিকায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী শাসনের দেড় দশকে সচিবালয়ে যেসব সুবিধাভোগী আমলারা নিজেকে আওয়ামীপন্থি হিসেবে জাহির করেছেন, তাদের অনেকে এখন ইউটার্ন নিয়ে আওয়ামী বিরোধী সেজেছেন। এমনকি আওয়ামী শাসনামলে জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেছেন এমন কর্মকর্তাও এখন সেজেছেন আওয়ামী বিরোধী হিসেবে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পরদিন সকাল থেকে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে বিএনপি ও জামায়াতপন্থি কর্মকর্তারা দলে দলে শোডাউন দিচ্ছেন। আর তাদের সাথে মিশে যাচ্ছেন এসব সুবিধাভোগী বর্ণচোরা কর্মকর্তারা। যাদের মধ্যে অনেকে ১৬ বছর আগেও ডিগবাজি দিয়েছিলেন। এদিকে সচিবালয়ে কর্মরত প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের পদনাম পরিবর্তন, পেশাগত ও বেতন বৈষম্য দূরীকরণ, বেতন কমিশন গঠনসহ দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ও হতাশা নিরসনের জন্য আবেদন জানিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী নেতারা। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জৈষ্ঠ্যসচিব মোহাম্মদ মেজবাউদ্দিন চৌধুরীর কাছে এসব দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি দেন বলে জানা গেছে। এছাড়া দলবাজির কারণে বিভিন্ন বেসরকারি, আধা-সরকারি ও সায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের দু-একজন পদত্যাগ করতে শুরু করেছেন। সর্বশেষ ইউসিজির চেয়ারম্যান পদত্যাগ করেছেন বলে জানা গেছে।