জি এম শাহনেওয়াজ ঢাকা থেকে ॥ খোলস বদলে জন-বান্ধব হওয়ার চেষ্টায় মরিয়া প্রশাসন যন্ত্রের আমলাদের শীর্ষ কর্মকর্তারা। কিছুদিন ধরে অন্তবর্তীকালিন সরকারকে বুঝাতে চাইছেন, অন্যের হুকুম তারা শুধু তালিম করেছেন। অনৈতিক কোনো কাজের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা নেই। বর্তমান গঠিন খন্ডকালিন সরকারের নিদের্শিত কাজও সূচারুভাবে করতে তৎপর থাকবেন। এর আগে গত ৬ আগস্ট সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণার মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদের ইতিঘটে। তবুও অভ্যুত্থানে বিদায়ী সরকারের মদদপুষ্ট আমলাদের দৌরাত্ন্য কমনি; বরং কয়েকদিন চুপ থাকার পর তৎপরতা বাড়ানো শুরু করে। এতে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয় ও এর বাইরে ক্ষোভ বিক্ষোভ অব্যাহত রাখতে দেখা যায় পদ বঞ্চিতদের। নানা অভিযোগের পরও প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে অন্তবর্তীকালিন সরকারের উপদেষ্টারা সভা-সমাবেশ ও দাপ্তরিক কাজ চালিয়ে নেন। উপদেষ্টারা বোঝার চেষ্টা করছিলেন, দল অন্ধ আমলারা কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারেন। এতে বঞ্চিত অনেকের মধ্যে দিন দিন বাড়ছিলো হতাশা। গত কয়েকদিন পর্যবেক্ষণের পর বুধবার একযোগে ১০জন সচিবের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এতেই বড় নড়াচড়া পড়ে শীর্ষ পদের কর্মকর্তাদের মধ্যে। এর পরও মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ ০৯জন সচিব চুক্তিভিত্তিক দায়িত্ব পালন করছেন। এর বাইরে বিসিএস ১৩ ব্যাচের কর্মকর্তা ও জন-নিরাপত্তা সচিব জাহাংগীর আলমকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়; এতে কিছু স্বস্তি ফেরে প্রশাসন ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-আন্দোলন শিবিরে। তিনি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একক কর্তৃত্ব দেখিয়ে নৌকার বিজয় নিশ্চিত করেন। এই কৃতকর্মের জন্য তাকে পুরস্কারস্বরুপ জন-নিরাপত্তা সচিব করেন সরকার। এতে বিদায়ী সরকারের আমলাদের খোলস বদলে সাধু সাজার যে রণ- কৌশল এগোচ্ছিলো তাতে কিছুটা ছেদ পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন প্রশাসনের একাধিক আমলা। বিসিএস ১৩ ব্যাচের একজন কর্মকর্তাকে ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কালিমা দিয়ে সিনিয়র সহকারি সচিব থেকে আর পদোন্নতি দেয়নি বিদায়ী সরকার। এ ধরণের কয়েকজন বঞ্চিত আমলা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বর্তমান প্রশাসনের শীর্ষ আমলারা নিজেদের নিরপেক্ষ প্রমাণে মরিয়া। যদি বর্তমান সরকার এদের দিয়ে প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত করেন পদত্যাগী শেখ হাসিনার মতো পরিণতি ঘটবে অন্তবর্র্তীকালিন উপদেষ্টাদের। অনেকেই ভালো মন্ত্রণালয়ের সচিব হওয়ার জন্য তৎপর। কেউ হতে চাইছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং কেউ মূখ্যসচিব। বর্তমান জন-প্রশাসনের সিনিয়র সচিব একজন দক্ষ খেলোয়াড় আমলা; তাকে গিরগিটির সঙ্গে তুলনা করতে পারেন। ক্ষণে ক্ষণে রং বদলান। তাকে বোঝা বড়ই মুশকিল। হতে চাইছেন, – মন্ত্রিপরিষদ সচিব। এই রং বদলানো কর্মকর্তার প্রতি আস্থা রাখলে সরকারের অবস্থা হেলে পড়লেও পুরাই পাল্টি খাবেন এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি, যোগ করেন ওই কর্মকর্তা। বর্তমান জন-প্রশাসন সচিবের একাধিক ব্যাচমেটও তার বিষয়ে অভিন্ন মত দেন। প্রশাসনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অন্তবর্তীকালিন সরকারের জন্য খুবই বিপজ্জন হয়ে উঠতে পারেন নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোস্তফা কামাল, স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান, ধর্ম সচিব মো হামিদ জমাদ্দার ও স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সচিব আজিজুর রহমান। এসব ধুরন্ধর আমলারা বর্তমানে খোলস বদলে পদ আটতে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। শুধু এসব সচিব না, অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সচিবরাও ইতিমধ্যে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে আস্থাভাজন হয়ে উঠার চেষ্টা চালাচ্ছেন। এর জন্য প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্য উপদেষ্টাদের বিভিন্ন আত্নীয় ও স্বজনদের মাধ্যমে কেউ কেউ কাছে পৌছানোর মাধ্যম খুঁজছেন বলেও খবর রটেছে। পদত্যাগী সরকারের সময়ে সেচ্ছাচারি ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ বিত্ত-বৈভবের মালিক হওয়ায় ক্ষমতায় আকঁড়ে থাকতে তৎপর তারা; আজীবন পদে থাকতে পারলেই যেনো স্বস্তি তাদের। প্রশাসনে চাওর হয়েছে, চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া জাহাংগীর আলম থেকে জন-নিরাপত্তা বিভাগ রাহুমুক্ত হলেও বর্তমান যাকে ওই পদে পদায়ন করা হয়েছে, – সে বিদায়ী সরকারের ঘনিষ্ট ও আস্থাভাজন ছিলেন। বর্তমান অন্তবর্তীকালিন সরকার পুলিশে যে সংস্কার ও শুদ্ধি অভিযান চালাতে চাচ্ছেন, এই মাফিয়া কর্মকর্তা থাকলে সেটির মহৎ উদ্দেশ্য ভেস্তে যেতে পারেন। কারণ তার বিষয়ে ওই সরকারের অনেক সচিব কোনঠাসা হয়ে পড়েন। এখনও কোনঠাসা আছেন। কয়েকজনের মধ্যে বিসিএস ১১ ব্যাচের কর্মকর্তা রয়েছেন বলেও জন-প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে। সরকারের অনেক অনৈতিক কাজে তারা ব্যবহ্নত না হওয়ায় সাইড লাইনে ফেলে রাখা হয়েছে। এদিকে, মাঠ প্রশাসনের দলবাজ কর্মকর্তা জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপার (এসপি) পদেও রদবদল আসছে শিগগিরই। বর্তমান মাঠ প্রশাসন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করলেও আওয়ামী লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন তারা এখনও। তাদের বিরুদ্ধে ছাত্র-আন্দোলনে সরকারকে নগ্নভাবে সহায়তা করার অভিযোগ উঠেছে। এমনকি বিদায়ী সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার জন্য কোনো কোনো জেলায় বি-শৃঙ্খলা করার গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে। জন-প্রশাসনের প্রাপ্ত তথ্যমতে, আগামী সপ্তাহে বঞ্চিত ও নানাভাবে হয়রানির শিকার হওয়া একডজনের মতো কর্মকর্তা সচিব পদে পদোন্নতি পেতে পারেন বলে জানা গেছে। এর মধ্যে ১১ ব্যাচের চার থেকে পাঁচজন, ১৩ ব্যাচের হাফ-ডজন এবং ১৫ ব্যাচের কয়েকজন কর্মকর্তা রয়েছে। যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে পদোন্নতি ও বিগত সরকারের বিরাগভাজন হওয়া কর্মকর্তাদের সচিব পদে পদোন্নতি দিতেই এই সময়ক্ষেপন করা হচ্ছে। সরকারের আস্থাভাজন প্রজাতন্ত্রের শীর্ষ কর্মকর্তা নিয়োগ না থাকার কারণে প্রশাসনিক ও স্পর্শকাতর অনেক সিদ্ধান্ত নেয়ায় ধীরে চলো নীতিতে এগোচ্ছে অন্তবর্তীকালিন সরকার। ত্যাগী ও নির্ভীক কর্মকর্তাদের উপযুক্ত পদে পদায়ন করার পর পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া হাসিনা সরকারের সাজানো প্রশাসন বলয়মুক্ত হবে এমন আভাস দেয়া হয়েছে নীতি-নির্ধারণী মহল থেকে।