জি এম শাহনেওয়াজ ঢাকা থেকে ॥ পদ নেই, তবুও মিলছে পদোন্নতি। তৎকালিন আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে পদ-বঞ্চিত ২০১জনকে গতকাল রবিবার পদোন্নতি দিয়ে যুগ্মসচিব করা হয়েছে। নতুন পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের স্বপদে (ইন সি টু) দায়িত্ব পালন করতে হবে বলে জন-প্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। কারণ বর্তমান এ স্তরের যে পদ রয়েছে তার দ্বিগুনের বেশি দায়িত্ব পালন করছেন। পদ না থাকার পরও পদোন্নতিতে বাড়ছে সরকারের দু:চিন্তা। মাথা ভারি হচ্ছে প্রশাসনের। এদিকে, রাজনৈতিক পরিচয়কে সামনে এনে গত দেড়যুগে আওয়ামী লীগ সরকার সদ্য পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের পদোন্নতি বঞ্চিত করে রেখেছিল। এসব কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে প্রায় একশ’ কর্মকর্তা অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পেতে পারেন। ইতিমধ্যে অতিরিক্ত সচিব পদের অতিরিক্ত পদোন্নতি দেয়া হয় পদত্যাগী সরকারের আস্থাভাজন কর্মকর্তাদের। নতুন পদোন্নতি পাওয়া সবাই ভূতাপেক্ষা অনুযায়ী তাদের প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পাবেন। জন-প্রশাসন মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রশাসনে যুগ্ম সচিবের পদ ৫০২টি। এই পদে এখন কর্মরত ৯৪৬ জন। নতুন পদোন্নতির পর যুগ্ম সচিবের সংখ্যা দাঁড়াল ১১৪৭জন। একই ভাবে, ২০২৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ৯৮ জন যুগ্মসচিবকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দিয়েছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ বিদায়ী সরকার চলতি বছরে প্রশাসনে ১২৭ জন যুগ্মসচিবকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দিয়েছিল। পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের ১৮তম ব্যাচকে নিয়মিত ব্যাচ হিসাবে সে সময়ে বিবেচনা করা হয়। বর্তমানে ৪১৫ জন অতিরিক্ত সচিব কর্মরত। তবে সরকারের অতিরিক্ত সচিবের অনুমোদিত পদ ২১২টি। নতুন পদোন্নতি পাওয়া যুগ্ম-সচিবদের মধ্যে থেকে একশ’জনকে পদোন্নতি দেয়া হলে অতিরিক্ত সচিবের সংখ্যা হবে ৫১৫জন অর্থাৎ দ্বিগুনের বেশি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশাসনিক কাঠামোয় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই পদে পদোন্নতি পাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই কর্মকর্তারা খুশি। কিন্তু এই খুশির মধ্যেও আরেকটি বাস্তবতা আবারও সামনে এসেছে। সেটি হলো পদোন্নতি হলেও বেশির ভাগ কর্মকর্তাকেই কাজ করতে হবে আগের পদেই। অর্থাৎ তাঁরা সিনিয়র সহকারি সচিব বা উপসচিব হিসেবে যে কাজ করে আসছিলেন, এখনো সে কাজই করতে হবে। কারণ, এই পদোন্নতির পর নিয়মিত পদের চেয়ে কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি হয়ে গেছে। এই পরিসংখ্যান বলছে, নিয়মিত পদের চেয়ে ৬৪৫ জন যুগ্ম সচিব বেশি। এ কারণে এসব কর্মকর্তাকে স্বাভাবিকভাবেই আগের পদে কাজ করতে হবে। অন্য অনেককেও আগের পদে কাজ করতে হবে। কারণ, অতিরিক্ত সচিবের ক্ষেত্রেও নিয়মিত পদের চেয়ে কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি। এ জন্য ওই পদের অনেক কর্মকর্তা এখন যুগ্ম সচিবের কাজ করছেন। আবার এর আগে যাঁরা যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন, তাঁদেরও অনেকে এক ধাপ নিচের পদে, অর্থাৎ উপসচিব পদে কাজ করছেন। ফলে, যুগ্ম সচিবের নিয়মিত পদ খালি হলে তাঁরা আগে অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা। এ কারণে নতুন পদোন্নতি পেয়ে যুগ্ম সচিব হওয়া কর্মকর্তাদের খুব শিগগির নিয়মিত যুগ্ম সচিব পদে কাজ পাওয়া সহজ হচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা কথা বলতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, বঞ্চিত কর্মকর্তাদের মধ্যে বিসিএস একাদশ ব্যাচ থেকে ২৯তম ব্যাচ রয়েছে। ইতিমধ্যে উপসচিব পদে পদোন্নতি হয়েছে। গতকাল উপ-সচিব এর সঙ্গে আরও বঞ্চিত কয়েকজন কর্মকর্তাকে যুক্ত করে ২০১ জনকে যুগ্মসচিব করা হয়েছে। পদোন্নতি প্রাপ্ততরা সবাই জন-প্রশাসনে যোগদান করেছেন। ধাপে ধাপে পদায়ন করা হবে। এসব কর্মকর্তা থেকে চলতি কিংবা আগামী সপ্তাহের মধ্যে একশ’জনকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি হবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পদোন্নতিবঞ্চিত কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, আমরা গত ১৬ বছর বঞ্চনার শিকার ছিলাম। শুধু রাজনৈতিক কারণে আওয়ামী শাসনামলের আমরা পদোন্নতিবঞ্চিত ছিলাম। এক-দুজন নয়; কয়েক শ কর্মকর্তা। বলেন, বিশেষ উদ্দেশ্যে গোয়েন্দা তদন্ত প্রতিবেদনে আমাদের নামের সঙ্গে ‘নেগেটিভ’ উল্লেখ করে দেয়া হয়েছিল। অনেককে বছরের পর বছর ওএসডি থাকতে হয়েছে অথবা গুরুত্বহীন পদে ফেলে রাখা হয়েছিল। অনেককে বাধ্যতামূলক অবসরেও পাঠানো হয়। ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সামনে আসেন প্রশাসনে বিএনপি-জামায়াত ঘরানার বঞ্চিত কর্মকর্তারা। পরদিন ৬ আগস্ট সচিবালয়ে বৈঠক করেন পদোন্নতিবঞ্চিত অন্তত ২০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী। সভায় জ্যেষ্ঠতাসহ ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির দাবি জানান তাঁরা। এরপর তাঁরা প্রশাসনে কর্মরত বঞ্চিত কর্মকর্তাদের ব্যাচভিত্তিক তালিকা তৈরি করে পদোন্নতির জন্য সচিবের দপ্তরে জমা দেওয়া হয়। সংশি¬ষ্ট সূত্র বলেছে, ওই তালিকায় অন্তত ২৪৫ জনের নাম ছিল। এর মধ্যে বিসিএস ১১তম ব্যাচের ৪ জন, ১৩তম ব্যাচের ৮ জন, ১৫তম ব্যাচের ২১ জন, ১৭তম ব্যাচের ৮ জন, ১৮তম ব্যাচের ২২ জন, ২০তম ব্যাচের ২১ জন, ২১তম ব্যাচের ১০ জন, ২২তম ব্যাচের ৮১ জন, ২৪তম ব্যাচের ১২ জন, ২৫তম ব্যাচের ১২ জন, ২৭তম ব্যাচের ১৩ জন, ২৮তম ব্যাচের ১০ জন ও ২৯তম ব্যাচের ২২ জন রয়েছেন। এই তালিকায় থাকা কর্মকর্তাদের মধ্যে যাঁরা সিনিয়র সহকারী সচিব এবং যাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা ও দুদকের মামলা নেই, গত মঙ্গলবার রাতে প্রথম দফায় তাঁদের ১১৭ জনকে উপসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। আর গতকাল ২০১জনকে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। এর মাধ্যমে বঞ্চিত কর্মকর্তারা পদোন্নতি খেয়ে খুশি হলেও মাথা ভারি হচ্ছে প্রশাসনের। তাদের যোগ্যতানুযায়ী পদায়ন করা সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হবে এমনটাই ধারণা করছেন প্রশাসনের উদ্ধর্তন কর্মকর্তারা।