এফএনএস এক্সক্লুসিভ: জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নতুন করে ১০টি খাতে ভ্যাট বসানোর উদ্যোগ নিয়েছে। আর এ বাড়তি করের মাধ্যমে এনবিআর অতিরিক্ত পাঁচ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা আদায় করতে চায়। তবে সরকারের এমন সিদ্ধান্তে নতুন করে পণ্যমূল্য আরেক দফা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমান অন্তর্র্বতীকালীন সরকার বাজেটের আগেই নতুন করে চুনাপাথর, মোবাইল ফোন, সমুদ্রগামী জাহাজ, রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজার, পলিপ্রপাইলিন স্ট্যাপল ফাইবার, স্টেইনলেস স্টিল, স্যানিটারি ন্যাপকিন ও ডায়াপার, ফোর স্ট্রোক থ্রি-হুইলার, ইপিজেড ও অর্থনৈতিক অঞ্চলের শিল্পে ভ্যাটছাড় তুলে দিতে যাচ্ছে। এমনকি ওসবের কোনো কোনোটির ওপর বিভিন্ন হারে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের মতে, সরকারের এ সিদ্ধান্তে ব্যবসা-বাণিজ্য আরো ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং ভোক্তাদের আরো বেশি দামে পণ্য কিনতে হবে। ব্যবসা চালু করার আগে থেকেই ব্যবসায়ীরা বিদ্যমান সুবিধা ও চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় নিয়ে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু কর অব্যাহতি থাকায় বড় বিনিয়োগ করার পর হুট করে ওই সুবিধা তুলে দিলে ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ তুলতেই হিমশিম খেতে হবে। এনবিআর ও ব্যবসায়ীদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, চুনাপাথরের আমদানি পর্যায়ে বর্তমানে ৩৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক অব্যাহতি দেয়া আছে। এখন এনবিআর নতুন করে ওই হারে শুল্ক আদায় করতে চায়। এতে সিমেন্ট, নির্মাণ, রাসায়নিক, কাচ ও চিনি শিল্পে প্রভাব পড়বে। কারণ ওই খাতগুলোতে ব্যাপকভাবে চুনাপাথর প্রয়োজন হয়। এনবিআরের লক্ষ্য ওই পণ্যে শুল্ক অব্যাহতি তুলে দিয়ে তিন হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আদায়। বর্তমানে সিমেন্ট খাতের সব প্রতিষ্ঠান সংকটে আছে। এখন যদি এনবিআর ভ্যাট বাড়ায় তাহলে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। সিমেন্ট শিল্পের অপরিহার্য উপাদান ক্লিংকারের আমদানি মূল্য ৪২ ডলার, কিন্তু অ্যাসেসমেন্ট মূল্য ৬০ ডলার। এর ওপর ভ্যাট, এটি ও এআইটি দিতে হয়। এগুলো দিতে গিয়ে খরচ অনেক বেড়ে যায়। সূত্র জানায়, মোবাইল ফোন সেটের আমদানি ও উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া আছে। বর্তমানে উৎপাদন পর্যায়ে ২ শতাংশ, আংশিক উৎপাদনে ৫ শতাংশ এবং সংযোজনের ওপর ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট আছে। তবে রেয়াতি হারে ওই ভ্যাট সুবিধা তুলে নিয়মিত ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপের কথা ভাবছে এনবিআরের। এতে অতিরিক্ত এক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হবে। তবে এতে সাধারণ মানুষের জন্য মোবাইল ফোন কেনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। অথছ সরকার বলছে ইন্টারনেট ব্যবহার বাড়াবে। এখন ওই খাতে ভ্যাট বাড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হবে সেই পরিকল্পনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। মোবাইল ফোনে কখনোই ভ্যাট ছিল না। তবে এক বছর আগে স্তরভিত্তিক ভ্যাট যোগ করা হয়েছে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অনেক ভ্যালু অ্যাড হচ্ছে। এখন অন্য পণ্যের সঙ্গে যদি মোবাইল ফোনকে মিলিয়ে ফেলা হয়, তাহলে একটা ডিজাস্টার (দুর্যোগ) হবে। কারণ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অনেক টেকনোলজি ট্রান্সফার, ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ও অনেক বিনিয়োগ হচ্ছে। ভ্যাট যোগ হলে সাধারণ মানুষ মোবাইল কিনতেই পারবে না। ব্যবসায়ীরাও নতুন করে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবে না। এতে কর্মসংস্থানও বাধাগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। সূত্র আরো জানায়, একসময়ের আমদানিনির্ভর রেফ্রিজারেটর সরকারের করছাড় ও অন্যান্য সুবিধা পেয়ে এখন দেশীয় শিল্পে পরিণত হয়েছে। এতে সাশ্রয়ী মূল্যে সাধারণ মানুষ পণ্য কিনতে পারছে। দেশে অসংখ্য শিক্ষিত মানুষের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ তৈরি হচ্ছে। বর্তমানে ওই খাতটির জন্য উৎপাদন পর্যায়ে ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপিত আছে। তাছাড়া উপকরণ আমদানিতে ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক ও আগাম কর মওকুফ করা আছে। কিন্তু এনবিআর ওই খাতে ১০ শতাংশ ভ্যাট বসিয়ে ৩০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করতে চাচ্ছে। সরকারের এই সিদ্ধান্তে রেফ্রিজারেটরের দেশীয় বাজার নষ্ট হয়ে আমদানি করা পণ্য সহজলভ্য হবে। কারণ আমদানি করা ফ্রিজ ও দেশে উৎপাদিত ফ্রিজের দামে খুব একটা পার্থক্য থাকবে না। ফলে উৎপাদন বাদ দিয়ে আমদানির দিকে চলে যাওয়ার প্রবণতা বাড়বে। ছোট বাজার হওয়ায় নতুন নতুন ডিজাইন করে ফ্রিজ বিক্রি করলে বিনিয়োগ তুলতে চার-পাঁচ বছর সময় লাগে। আর আমদানি করলে খুব দ্রুত মডেলগুলো বাজারজাত করা যায়। দামে খুব একটা পার্থক্য না থাকলে মানুষ আমদানি করা ফ্রিজের দিকে চলে যাবে। তখন নি¤œ শ্রেণির মানুষের জন্য ফ্রিজ ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। তাছাড়া ভ্যাট বাড়িয়ে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর তালিকায় আছে স্যানিটারি ন্যাপকিন ও ডায়াপার। বর্তমানে ওই খাতের উপকরণ আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক ও আগাম কর অব্যাহতি দেয়া আছে। ওই খাতে ৫ শতাংশ আরোপ করলে অতিরিক্ত ১০ কোটি টাকা রাজস্ব পাবে এনবিআর। তবে প্রয়োজনীয় এই পণ্যের ওপর বাড়তি ভ্যাট আরোপ করলে ওই পণ্যটি আরো ব্যয়বহুল হবে। তখন অনেকেই কিনতে পারবে না। বাংলাদেশে মাত্র ২০ শতাংশ নারী স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করতে পারে। বাকি ৮০ শতাংশ নারী পুরনো কাপড়, তুলা ব্যবহার করে। এ কারণে ইনফেকশনের পাশাপাশি ক্যান্সারের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। এখন ব্যবহার বৃদ্ধির পরিবর্তে যদি আরো ব্যয়বহুল করা হয়, তাহলে অবশ্যই সমস্যা হবে। আর ডায়াপার ব্যবহারের হার মাত্র ৯ শতাংশ। এখন খরচের কারণে বাচ্চাদের ডায়াপার পরাতে না পারা খুবই দুঃখজনক হবে। ওই চারটি খাত ছাড়াও সমুদ্রগামী জাহাজ আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি থাকলেও ওই খাতে ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করতে চায় এনবিআর। প্রলিপ্রপাইলিন স্ট্যাপল ফাইবারের আমদানি ও উৎপাদন পর্যায়ে ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট, উপরকণ আমদানিতে ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক ও আগাম কর অব্যাহতি আছে। এখানে ভ্যাট অব্যাহতি তুলে দিতে চায় রাজস্ব বোর্ড। এ ছাড়া ফোর স্ট্রোক থ্রি-হুইলার, রোলড স্টেইনলেস স্টিল, শতভাগ রপ্তানিকারক, প্রচ্ছন্ন রপ্তানিকারক ও ইপিজেডে অবস্থিত প্রতিষ্ঠান ও অর্থনৈতিক অঞ্চলে অবস্থিত শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ভ্যাট অব্যাহতি তুলে দিয়ে এনবিআরের বাড়তি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য। এদিকে ১০ খাতে শুল্ক অব্যাহতি তুলে দিলে পাঁচ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় হবে বলে ধারণা করছে এনবিআর। সম্প্রতি ভ্যাট আদায় বাড়ানো বিষয়ে একটি সভায় ভ্যাট আদায়ের সার্বিক চালচিত্র নিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান একটি বৈঠক করেন। সেখানে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে কোন কোন খাতে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে, কোথায় অব্যাহতি তুলে দেয়া হয়েছে, অটোমেশন, কর্মকৌশল ও কর অব্যাহতির প্রজ্ঞাপন বাতিল করে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। যেসব খাতে ভ্যাট অব্যাহতি তুলে দিয়ে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে, সেই খাতগুলো এখন প্রতিষ্ঠিত। তাদের বাজারে অবস্থান তৈরি করতে দীর্ঘদিন অব্যাহতি সুবিধা দেয়া হয়েছে। এখন সেই অব্যাহতি আর নিয়মিত করার কোনো কারণ দেখছে না এনবিআর। যদিও এর আগে অর্ন্তর্বতী সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাজার নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ হিসেবে চাল, ভোজ্য তেল, চিনি, ডিম, খেজুর, আলু, পেঁয়াজ ও কীটনাশক আমদানিতে শুল্ক-কর ছাড় দিয়েছে এনবিআর। তাতে অনিয়ন্ত্রিত বাজারে তেমন একটা নিয়ন্ত্রণ আসেনি। অন্যদিকে নতুন করে ভ্যাট বসানো প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদদের মতে, ব্যবসায়ীরা যখন কোনো খাতে বিনিয়োগ করেন তখন তার খরচের প্রবাহ, বিনিয়োগের সুরক্ষা, নীতিগত সহায়তা, আয় কেমন হবে তার হিসাব কষেই বিনিয়োগ করেন। যেকোনো খাতে নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে তার ধারাবাহিক বাস্তবায়নের বিষয়টি বিবেচনা করা জরুরি। নীতি ধারাবাহিকভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব না হলে সে ক্ষেত্রে আগে থেকেই বিষয়টি জানিয়ে দেয়া প্রয়োজন। সরকার যদি হুট করে ঘোষিত নীতি থেকে পিছু হটে যায়, সে ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের জন্য একটা চিন্তার বিষয়। হুটহাট নীতির পরিবর্তন কখনোই ভালো সিদ্ধান্ত নয়। এখন দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো নয়। রাজস্ব আদায়েও শ্লথগতি দেখা যাচ্ছে। রাজস্ব আদায় বাড়াতে না পারলে তখন আরেকটি নতুন সমস্যা তৈরি হবে। এ ছাড়া এনবিআরকেও রাজস্ব আদায় করতে হবে। তবে বর্তমানে দেশের সাধারণ মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপে আছে। তাই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর কোনো ধরনের বাড়তি ভ্যাট আরোপ করা উচিত হবে না। এতে বাজার ব্যবস্থাপনায় চাপ পড়ার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতিও আরো বাড়তে পারে।