এফএনএস: বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের পর ব্রিটেনে এসে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন সাবেক সংসদ সদস্য ও নেতা। বাকিরা এসেছেন মাল্টিপল এন্ট্রির ভ্রমণ ও বিনিয়োগকারীসহ নানান ভিসায়। সাবেক এমপি নজরুল ইসলাম বাবু আছেন সুইজারল্যান্ডে। পর্তুগালসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও আছেন নেতারা। অনেকে আছেন সৌদি আরব, সারা বছরের ভিসা নিয়ে। দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে আওয়ামী লীগের অনেক দাপুটে নেতাকে। এখন পর্যন্ত অন্তত তিন নেতার ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তারা হলেন- আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি রনজিত চন্দ্র সরকার, বিধান কুমার সাহা ও সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের উপপ্রচার সম্পাদক সুয়েব আহমদ। এরই মধ্যে একজনের অ্যাসাইলাম আবেদন মঞ্জুর হয়েছে। তিনি এখন স্ত্রী-সন্তানকে ব্রিটেনে আনার প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। যুক্তরাজ্যে আসা নেতাদের কেউ কেউ লন্ডনে দলীয় অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন এবং নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। আবার অনেকে নীরবে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন, এড়িয়ে যাচ্ছেন নেতাকর্মীদের। রণজিৎ সুনামগঞ্জ-১ আসন থেকে ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিধান কুমার সাহা। এ দুই জন সিলেট সিটির সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর ঘনিষ্ঠজন। খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর মেয়ে আগে থেকেই লন্ডনে পড়াশোনা করতেন। এ সুবাদে যুক্তরাজ্যে আসা-যাওয়া ছিল। তার স্ত্রীও ব্রিটেনে নিয়মিত আসা–যাওয়া করেন। তারা আছেন লন্ডনে। সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদও আছেন সেখানে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য আব্দুর রহমানও যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। তার ছেলেও ব্রিটেনে পড়াশোনা করেছেন। সিলেটের সাবেক এমপি ও যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা শফিকুর রহমান চৌধুরী তার দেখভাল করছেন। এছাড়াও যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান কবির বিন আনোয়ার, সিলেট সিটির সাবেক কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ। আজাদের স্ত্রী নাজমা রহমান লন্ডনের ক্যামডেন কাউন্সিলের সাবেক মেয়র। কবিরের মেয়ে লন্ডনে অধ্যয়নরত। সূত্র জানায়, শেখ হাসিনা সরকার পতনের দিন বিকালে সিলেটের তামাবিল সীমান্ত দিয়ে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতা ভারতে পাড়ি জমান। পরবর্তীতে ইমিগ্রেশন করে বৈধপথে ভারতে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠায় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের কয়েক শ’ নেতাকর্মী সিলেটের গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও কানাইঘাটের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে ভারতে চলে যান। জানা গেছে, ভারত হয়ে সর্বপ্রথম যুক্তরাজ্যে পৌঁছান সিলেট সিটি করপোরেশনের অপসারিত মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। পরে আসেন সিলেট-৩ আসনের সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান হাবিব। এরপর যারা ভারতসহ বিভিন্ন গন্তব্য থেকে যুক্তরাজ্যে পৌঁছান তাদের মধ্যে রয়েছেন- সাবেক প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী। আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, হাবিবুর রহমান হাবিব ও আজাদুর রহমান ব্রিটিশ নাগরিক। জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ও পাবনা-১ আসনের সাবেক এমপি শামসুল হক টুকু প্রথমবার প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর তার ছেলে বেড়া পৌরসভার সাবেক মেয়র আসিফ শামস রঞ্জন বেশ কিছু সম্পত্তি কেনেন ব্রিটেনে। স্ত্রী-সন্তানরা ব্রিটেনে বসবাস শুরু করেন। তিনিও এখন লন্ডনে বসবাস করছেন। অন্য দেশের ভিসা না থাকায় যারা ভারতে আটকা পড়েছেন তারা রয়েছেন বিপাকে। দেশে ফেরা অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় তারা দীর্ঘদিন ভারতে অবস্থানের চিন্তা-ভাবনা করছেন। বৈধভাবে কীভাবে দীর্ঘদিন ভারতে অবস্থান করা যায় সেটা নিয়ে তারা পরিকল্পনা করছেন। ব্রিটেনের দ্য টেলিগ্রাফ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের মার্চ মাস থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ১১ হাজার বাংলাদেশি ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেন। এসব বাংলাদেশি ব্রিটেনে এসেছেন ছাত্র, কর্মী কিংবা ভ্রমণ ভিসা নিয়ে। এরপর তারা রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করে ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে বসবাসের চেষ্টা করছেন। যারা রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছেন, তাদের মাত্র পাঁচ শতাংশের আবেদন সফল হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। চলতি বছরের ১৬ মে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার একটি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) চুক্তি সই করে। এর আওতায় আশ্রয়ের আবেদন করে সফল না হওয়া বাংলাদেশিদের দ্রুত দেশে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নিতে পারবে যুক্তরাজ্য। জানা গেছে, বিগত আওয়ামী লীগ আমলে শেখ হাসিনা লন্ডনে এলেই বিমানবন্দর আর তার হোটেলের সামনে বিক্ষোভ করতেন কয়েকশ বিএনপি নেতাকর্মী। তাদের মধ্যে ছবি-ভিডিওতে সামনে থাকতেন অ্যাসাইলামের আবেদন জেতার অপেক্ষায় থাকা বিএনপির নেতাকর্মী পরিচয়ে অ্যাসাইলাম প্রত্যাশীরা। শত শত পুলিশ মোতায়েন রাখতে হতো হোটেলের সামনে, বিমানবন্দরে। পাল্টা জমায়েত আর স্লোগান দিতেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এ পরিস্থিতিতে টানা বিক্ষোভের কারণে শেখ হাসিনা যে হোটেলে থাকতেন সেখানে আর কোনও অতিথির প্রবেশ বা বের হওয়া দুরূহ হয়ে পড়তো। একপর্যায়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর জন্য হোটেল বুকিং দিতে ব্যর্থ হয় খোদ বাংলাদেশ হাইকমিশনও। শেখ হাসিনার একজন উপদেষ্টা তখন তার ভারতীয় চ্যানেল ব্যবহার করে হোটেল কনফার্ম করতেন। এমন পরিস্থিতিতে লন্ডনে শেখ হাসিনাবিরোধী বিক্ষোভ দমাতে বাংলাদেশ সরকারের আগ্রহে অনেকটা নিজেরা উদ্যোগী হয়ে তড়িঘড়ি করে ওই চুক্তি করেন তৎকালীন বিতর্কিত হাইকমিশনার মুনা তাসনিম, এমন আলোচনা ছিল বিভিন্ন মহলে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন এ চুক্তি খোদ আওয়ামী লীগের অ্যাসাইলাম প্রত্যাশীদের বিপাকে ফেলতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন লন্ডনের চ্যান্সেরি সলিসিটর্সের প্রিন্সিপাল সলিসিটর ব্যারিস্টার মো. ইকবাল হোসেইন।