এফএনএস : আজ সোমবার মহান বিজয় দিবস। ১৯৭১ সাল থেকে ১৬ ডিসেম্বর শুধু ক্যালেন্ডারের পাতায় লাল তারিখ নয়, জাতীয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। নির্বিশেষে সকল বাংলাদেশীর স্বপ্নমালা, আবেগঘন এ দিবস বছর ঘুরে এসেছে সাড়ম্বরে। রক্ত ও সম্ভ্রমের দামে কেনা ঐতিহাসিক এ দিনটিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপনে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচি নিয়েছে।
দীর্ঘ দুই যুগের বেশি সময় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শোষণমূলক শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন ও তার শেষ অধ্যায়ে টানা নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পর অগ্নিঝরা একাত্তরের এই দিনে হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্যদিয়ে আমাদের বিজয় অর্জিত হয়। বন্দীমুক্ত দেশবাসী পায় স্বাধীনতার স্বাদ। তাই তো প্রতিবছর ডিসেম্বরের ষোড়শ দিবস প্রত্যুষে ওঠা রাঙ্গা সূর্য বাংলাদেশীদের জন্য প্রণোদনা হিসেবে আবির্ভূত হয়। বিজয়ের গৌরবদীপ্ত এই দিনটি সীমাহীন আনন্দের, উল্লাসের এবং পরম অর্জনের দিন। ৫৩ বছর আগে ঠিক এই দিনে বিকেল ৪টা ১৯ মিনিটে ঢাকার তৎকালীন ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সেনাপ্রধান লে. জেনারেল একে নিয়াজী তার ৯৩ হাজার পরাজিত পাকিস্তানী সৈন্যসহ ভারতের পূর্বাঞ্চলের সেনাপ্রধান লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেন। যবণিকাপাত হয় পাকিস্তানী অত্যাচার আর নির্যাতনের। পাকিস্তানী সৈন্যের এ আত্মসমর্পণ ছিল মূলতঃ যৌথ বাহিনীর কাছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনী যৌথভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক ছিলেন জেনারেল মোঃ আতাউল গনি ওসমানী। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের সময় তিনি ঢাকায় এসে পৌঁছতে পারেননি। তার বদলে এসেছিলেন ডেপুটি চিফ অব স্টাফ এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকার। যুদ্ধের নিয়মে এ দিনই পাকিস্তানের চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে।
তবে এ ভূখ-ের মানুষের স্বাধীনতার জন্য, বিজয়ের জন্য লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস কম পুরানো নয়। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন ভাগীরথীর তীরে পলাশীর আমবাগানে বিদেশী বেনিয়াদের কাছে পরাজিত হবার পর পরই মূলতঃ শুরু হয় এ জাতির মুক্তিসংগ্রাম। ফকির মজনু শাহ, তিতুমীর, হাজী শরীয়তুল্লাহর নেতৃত্বে যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তা-ই পরবর্তীতে সিপাহী বিপ্লব, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন এবং পাকিস্তান লাভের মধ্যদিয়ে বিকশিত ও প্রসারিত হয়। বৃটিশ-ব্রাহ্মণ্যবাদি চক্রান্তের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্যদিয়ে পাকিস্তান অর্জিত হলেও তৎকালীন পাকিস্তানী শাসকদের হঠকারিতা এবং শোষণের জন্য এ দেশের প্রতিটি মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় অনাস্থা ও অবিশ্বাসের বিভেদ রেখা। সেই সাথে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী দলকে মেনে না নেয়ার পর বিক্ষোভে ফেটে পড়ে বাংলাদেশের ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা, সামরিক-বেসামরিক লোকজন। সত্তরের সাতই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভরাট কণ্ঠের জাদুমাখা ভাষণ- ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম….’ স্বাধীনতার স্পৃহাকে আরো বেগবান করে।
স্বাধীনতাই যখন তৎকালীন পূর্ববাংলার মানুষের প্রথম ও শেষ চাওয়া, তখন একাত্তরের ২৫শে মার্চ কালো রাতে পাকবাহিনী নির্মম হত্যাকান্ড চালায় মুক্তিকামী নর-নারী ও শিশুদের ওপর। এতে স্তম্ভিত হয়ে যায় গোটা দেশ। বিশ্ব বিবেকও এমন ন্যক্কারজনক ঘটনায় চুপ থাকতে পারেনি।
মুক্তিপাগল জনতা তখন ঝাঁপিয়ে পড়ে বিজয়ের জন্য। ‘একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে’ সশস্ত্র সংগ্রামে শরীক হয় সর্বস্তরের মানুষ। দীর্ঘ নয় মাস অনেক ত্যাগ-তিতীক্ষা, রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের ভেতর দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পরাধীনতা গ্লানি, শোষণ-বঞ্চনার পীড়নমুক্ত হই আমরা।
সমরবিদ ও বিশ্লেষকদের মতে, দুনিয়াব্যাপী দেশ শত্রুমুক্ত করার স্বল্পতম সময়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সবচেয়ে বীরত্বপূর্ণ গৌরবগাঁথা ও ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর। এমন একটি সংগ্রামের ইতিহাস এ দেশের মানুষকে করেছে সারাবিশ্বে মর্যাদাবান, করেছে স্বাধীন-সার্বভৌম। দিয়েছে আত্মপরিচয়ের নিশানা লাল-সবুজের পতাকা, দিয়েছে স্বকীয়তার স্বীকৃতী। বিশ্ব মানচিত্রে দিয়েছে একক পরিচয়ে অবস্থান।
আজকের টগবগিয়ে ওঠা সূর্যের সাথে জনগণও দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃঢ় শপথ নিতে হবে। যাদের একটি বিজয় দিবস রয়েছে, তারা কখনোই পরাভব মানে না। মানতে পারে না। সেই শক্তি ও সাহস নিয়েই আমরা হবো আগুয়ান। কণ্ঠে কণ্ঠে গীত হবে ‘‘সব ক’টা জানালা খুলে দাও না/ আমি গাইবো গাইবো বিজয়েরই গান।’’