জি এম শাহনেওয়াজ ঢাকা থেকে \ আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআরবি) হাসপাতালে পানিবাহিত (ডায়রিয়া) রোগীর ঢল নেমেছে। রোগীর চাপ সামলে তাদের চিকিৎসা দিতেই হিমশিম অবস্থা কর্তৃপক্ষের। এ চাপ সামলাতে নিয়মিত চিকিৎসকদের পাশাপাশি গবেষণায় সম্পৃক্ত চিকিৎসকদের এতে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, অস্থায়ী কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়িয়ে সামলানো হচ্ছে বাড়তি রোগীর চাপ। তবে, সব বয়সী (শিশু থেকে বয়স্ক) মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এদিকে, রোগীর সংখ্যা এবার অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। আইসিডিডিআরবির তথ্য বলছে, গত ৪২ দিনে ৪২ হাজারের বেশি রোগী ভর্তি ও তাদের চিকিৎসা দিয়েছে তারা। প্রতিনিয়ত ভর্তি হচ্ছে নতুন নতুন রোগী। গড় হিসাবে, -প্রতি ঘন্টায় রোগী ভর্তি হচ্ছে বিশেষায়িত এই হাসপাতালে ৫০জন এবং দৈনিক ১০০০ জনকে চিৎকিসা দিতে হচ্ছে তাদের। তবে, রোগী ভর্তির অনুপাতে মৃতে্যুর হার শূন্য দশমিক জিরো জিরো শতাংশ। কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, গত ১ মার্চ থেকে হাসপাতালে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত রোগীর আসা শুরু হয়। গতকাল পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি থেকে এবং বাসা থেকে বেরিয়ে পথেই মৃত্যু রোগীর সংখ্যা ৩১জন। যার মধ্যে ভর্তির একঘন্টায় মৃত রোগীর সংখ্যা মাত্র ৪জন এবং হাসপাতালে ভর্তির হওয়ার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বেরিয়ে পর্থেই মারা গেছে ২৭জন। এর মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর মারা যাওয়া চারজনের ভর্তির পর পালস পাইনি কর্তব্যরত চিকিৎসক এবং রোগীর অবস্থাও ছিল মুমুর্ষ। চিকিৎসা কার্যক্রম শুরুর আগেই তারা মারা যান। তাই ডায়রিয়া ও বমির প্রার্দুভাব দেখা মাত্রই রোগীর স্বজনের উচিত নিকটস্থ সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা। আইসিডিডিআরবি বলছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহায়তায় ডায়রিয়া রোগীর চিকিৎসা সহজলভ্য করার জন্য সরকারি হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসকদের আইসিডিডিআরবির প্রশিক্ষিত গবেষকরা প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। এর মাধ্যমে ডায়রিয়া ও বমির প্রাথমিক চিকিৎসা যাতে রোগীরা নিকটস্থ সরকারি হাসপাতালে নিতে পারেন। ভর্তির পর শারিরীর অবস্থা স্থিতিশীল না হলে চিকিৎসকের চাহিদাপত্র নিয়ে আইসিডিডিআরবিতে আসতে পারেন। এ জন্য মানুষকে সচেতন করতে পরামর্শ দিচ্ছে আইসিডিডিআরবি কর্তৃপক্ষ। কারণ রাজধানীর আশপাশের এলাকা নয় দূর-দুরন্ত থেকেই রাজধানীর মহাখালী উদরাময় হাসপাতালে ভর্তির উদ্দেশ্যে আসছেন অসংখ্য রোগী। ময়মনসিংহ, নারায়নগঞ্জ, গাজীপুর ও মানিকগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য এসেছে অনেকে। গতকাল সোমবার সরেজমিন বিভিন্ন রোগীর স্বজনের সঙ্গে আলাপে রাজধানীর বাইরে থেকে আসা রোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে। চিকিৎসকরা বলছেন, মার্চের শেষ থেকে বর্ষা শুরুর আগ পর্যন্ত পাওয়া যায় ডায়রিয়া রোগী। কিন্তু এবার মার্চের প্রথম থেকেই প্রচুর ডায়রিয়া রোগীর সন্ধান পেয়েছেন তারা। প্রতিদিনই বাড়ছে এ রোগী। তবে করোনার সঙ্গে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ভর্তি রোগীর সংশ্লিষ্টতা নেই বলে জানায় কর্তৃপক্ষ। জানতে চাইলে আইসিডিডিআরবির সিনিয়র ম্যানেজার তারিফুল ইসলাম বলেন, মূলত মার্চের শেষ থেকে এপ্রিল অর্থাৎ বর্ষা মৌসুম শুরুর আগ পর্যন্ত ডায়রিয়ার প্রকোপ থাকে। আর শীত মৌসুমে কিছুটা প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। চলতি বছরে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বেশি। এটাই শঙ্কার কারণ। সব বয়সি মানুষ পাওয়া যাচ্ছে। এটা করোনার প্রাদুর্ভাব থেকে নয়, সিজন্যাল। তিনি বলেন, গত মার্চের ১ তারিখ থেকে এখন পর্যন্ত ৪২ হাজার রোগীর ভর্তি এবং সেবা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ভর্তি হওয়ার একঘন্টার মধ্যে মারা গেছে মাত্র ৪জন। এই চারজনের ভর্তির জন্য যখন হাসপাতালে আনা হয়েছিল তখনই অবস্থা মুমূর্ষ ছিল। অনেকের পালস পাওয়া যাচ্ছিল না। আর হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই মারা গেছে ২৭জনের মতো। পরিসংখ্যান রাখা সম্ভব হয় না অনেক ক্ষেত্রে আমাদের পুরো হিউম্যান রির্সোস রোগীয় সেবায় নিয়োজিত। সিনিয়র এই ম্যানেজার আরও বলেন, আমাদের পরামর্শ হচ্ছে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা মাত্রই নিকটস্থ সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এবং প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে কিছুটা স্ট্রেবল হলে তারপর আইসিডিডিআরবিতে নিয়ে আসা উচিত তাহলেও চিকিৎসা নিয়ে দ্রুত ঘরে ফিরতে পারবেন। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের সহায়তা নিয়ে সরকারি বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসকদের ডায়রিয়া ব্যবস্থাপনার উপরে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন বলে জানান। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে আইসিডিডিআরবিতে ভর্তি হয়েছেন ধনিয়া এলাকার নুরজাহান (৮০)। গত রাত থেকে ঘন ঘন পাতলা পায়খানার সঙ্গে মুহু মুহু বমি শুরু হয়। স্যালাইনসহ সব ধরণের চিকিৎসা নিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর নিরুপায় হয়ে সকালেই ভর্তি হন এখানে। সোমবার দুপুর পর্যন্ত নিয়মিত বিরতিতে চলছিল পাতলা পায়খানা ও বমি। আর ভিতরে রোগী রেখে বাইরে পিচের উপরে বসে বিলাপ করতে দেখা যায় ময়মনসিংক এলাকার থেকে আসা রানী আক্তার (৪০)’কে। বলেন, ভিতরে রোগীর গন্ধে সে নিজেও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। তাই বাইরে অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ পর পর ভিতরে গিয়ে রোগীকে দেখে আসছে তিনি। গত ১০ ও ১১ এপ্রিল তারিখে রোগী ভর্তির এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শনিবার দিনগত রাত ১২টা থেকে পরবর্তীদিন ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় রোগী ভর্তি হয়েছে ১২০৪জন; যার মধ্যে প্রথম ঘন্টায় ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল ৬১জন। গতকাল সোমবার প্রথম ঘন্টায় ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল ৪৪জন এবং দুপুর ২টা পর্যন্ত চৌদ্দ ঘন্টায় ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৪৯জন। সরেজমিন বিকাল পর্যন্ত হাসপাতালে অবস্থান করে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নতুন নতুন রোগী ভর্তির জন্য আসতে দেখা যায়। এসব রোগী ভর্তি ও চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে দেখা গেছে কর্তৃপক্ষকে। পরিস্থিতি বলছে, গত ৪২ দিনে ডায়রিয়া রোগীর ঢল কমেনি, বরং বেড়েছে।