উত্তাল প্রেক্ষাপট
এফএনএস: ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ। উত্তাল এক প্রহর। সারা বাংলাদেশ জুড়ে তখন ক্ষোভ, উদ্বেগ ও প্রতিরোধের স্ফুলিঙ্গ। একদিকে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক জান্তা স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের দমন করতে চূড়ান্ত ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে, অন্যদিকে বীর বাঙালি প্রতিরোধের শপথ নিয়ে প্রস্তুত হচ্ছে চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদিন স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দেন, “আর আলোচনা নয়, এবার চাই সিদ্ধান্ত। আগামীকালের মধ্যে সমাধান না হলে বাঙালি নিজের পথ নিজেই ঠিক করে নেবে।” এর মধ্যেই পাকিস্তানি বাহিনী রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের সামরিক অবস্থান শক্তিশালী করার চেষ্টা চালাচ্ছিল। ২৪ মার্চের অন্যতম হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে চট্টগ্রাম বন্দরে। ‘সোয়াত’ নামক একটি জাহাজ বন্দরে ভিড়ে, যার গর্ভে লুকানো ছিল ৫,৬৩০ টন অস্ত্র। এই অস্ত্র নিয়ে আসা হয়েছিল বাঙালিদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ দমন—পীড়নের জন্য। বন্দরের বাঙালি শ্রমিকরা যখন জানতে পারে যে এই অস্ত্র তাদেরই নিধন করতে ব্যবহার করা হবে, তখন তারা একযোগে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বীর শ্রমিকরা প্রাণের মায়া ত্যাগ করে অস্ত্র নামাতে অস্বীকৃতি জানায়। এই সাহসী প্রতিরোধে পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তারা বেসামাল হয়ে যায়। শ্রমিকদের বাধা উপেক্ষা করে অস্ত্র খালাসের চেষ্টা করলে উত্তেজনা চরমে ওঠে। একপর্যায়ে নির্মমভাবে গুলি চালায় পাক সেনারা। বহু শ্রমিক শহীদ হন, আরও অনেকে গুরুতর আহত হন। এ ঘটনা মুক্তিপাগল বাঙালির মনে আরও ক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এই দিনটিতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির সামনে হাজারো মানুষ সমবেত হয় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য। জনতার উদ্দেশে তিনি বলেন, “সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ। আমাদের দাবিয়ে রাখার কোনো ষড়যন্ত্র সফল হবে না।” তিনি আরও বলেন, “সরকার যদি আমাদের ওপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চায়, তবে বাঙালি তা মেনে নেবে না। আমরা নিজেদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনব।” বঙ্গবন্ধুর এই দৃঢ় কণ্ঠস্বরে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, বাঙালির সামনে একটাই পথÑস্বাধীনতা। এই দিন থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। একে একে তারা ঢাকা ছাড়তে শুরু করে। পশ্চিম পাকিস্তানের ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা গোপনে করাচির উদ্দেশে রওনা হন। জুলফিকার আলী ভুট্টোর সফরসঙ্গীদের মধ্যে সাতজন এদিন ঢাকা ত্যাগ করেন। এই সময়ে পাকিস্তান থেকে খান আবদুল কাইয়ুম খান ঢাকায় আসেন ইয়াহিয়া খানের আমন্ত্রণে। তিনি এসে ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সঙ্গে এক বৈঠকে বসেন। বৈঠকের পর ভুট্টো সাংবাদিকদের সামনে আসেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের বিষয়ে ‘‘সহানুভূতিশীল’’ মনোভাব প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “পূর্ব পাকিস্তান বাস্তবিকই শোষণ ও বঞ্চনার শিকার।” কিন্তু এই কথার আড়ালে যে ভয়ঙ্কর গণহত্যার নীলনকশা তৈরি হচ্ছিল, তা বাঙালির ধারণারও বাইরে ছিল। এই দিনে ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের সর্বত্র স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ছিল। সরকারি—বেসরকারি অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এমনকি সেনানিবাসের কিছু অংশেও এই পতাকা উড্ডীন হতে দেখা যায়। যশোর ট্রাঙ্ক রোডের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসেও স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ানো হয়, যা ছিল এক সাহসী পদক্ষেপ। সর্বত্র মুক্তিকামী জনতা স্বাধীনতার শপথ নিচ্ছিল। সরকারি ভবনগুলোর শীর্ষে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়তে দেখে অনেকেই উজ্জীবিত হয়ে নিজের ঘরে, দোকানে ও স্কুল—কলেজের ছাদে একই পতাকা উত্তোলন করে। এই উত্তাল পরিস্থিতির মধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ভয়াবহ কিছু পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে থাকে। সৈয়দপুর সেনানিবাসের আশপাশের বোতলগাড়ি, গোলাহাট ও কুন্দুল গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনী ও অবাঙালি দোসররা মিলে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। এতে শতাধিক নিরীহ বাঙালি নিহত হন এবং সহ¯্রাধিক আহত হন। এই দিনে বাঙালি হয়তো ভাবতেও পারেনি যে, মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে তাদের ওপর নেমে আসবে ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস রাতÑ‘অপারেশন সার্চলাইট’। ২৪ মার্চ ছিল এক অগ্নিময় দিন, যেখানে স্বাধীনতার শপথ, প্রতিরোধ ও রক্তাক্ত সংগ্রামের বীজ রোপিত হয়েছিল। পরদিনের ভয়াল রাতের অন্ধকারে জন্ম নেবে নতুন সূর্য, রক্তিম সূর্যÑবাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্য।