শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ০১:৫৯ পূর্বাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম ::
ভূস্বর্গ কাশ্মির এখন জনশূন্য \ সীমান্তে গোলাগুলি সিমলা চুক্তি স্থগিত ও ভারতের ওপর প্রভাব \ বেলুচিস্তানে বোমা হামলায় ৪ নিরাপত্তা কর্মী নিহত গাড়িবোমা হামলায় রুশ জেনারেল নিহত শোলমারি সুইসগেট ও ভরাট নদী পরিদর্শনে খুলনা জেলা প্রশাসক বহেরা বাজার কমিটির নির্বাচন সভাপতি রাজীব—সম্পাদক রানা কলারোয়ায় মেয়েকে গলা কেটে হত্যা করল মা কলারোয়ায় বিএনপি’র সাংগঠনিক কমিটির মতবিনিময় সভায় সাবেক এমপি হাবিব থামছে না সুন্দরবনে হরিণ শিকার যশোরে হাসপাতালের শৌচাগারে মিলল নবজাতকের লাশ সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে যুবক আহত পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে রোমে পেঁৗছেছেন ড. ইউনূস

ভূস্বর্গ কাশ্মির এখন জনশূন্য \ সীমান্তে গোলাগুলি সিমলা চুক্তি স্থগিত ও ভারতের ওপর প্রভাব \ বেলুচিস্তানে বোমা হামলায় ৪ নিরাপত্তা কর্মী নিহত

দৃষ্টিপাত ডেস্ক :
  • আপডেট সময় শনিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৫

আন্তর্জাতিক ডেস্ক \ ভারতশাসিত কাশ্মিরের পহেলগামে পর্যটকদের ওপর বন্দুকধারীদের হামলার ঘটনায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। দুই পক্ষই প্রতিশোধমূলক পাল্টপাল্টি পদক্ষেপ নিয়েছে। এরই মাঝে সীমান্তে দুই বাহিনীর মধ্যে গতকাল গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। তবে কেউ হতাহতের ঘটনা ঘটেনি এবং উভয় পক্ষ একে অপরকে গুলি চালানোর বিষয়ে দোষারোপ করছে। মঙ্গলবারের ঘটনার পর দ্রুত কতগুলো সিদ্ধান্ত জানায় দিল্লি। এই তালিকায় সিন্ধু পানি বণ্টন চুক্তি স্থগিত, প্রধান সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ করে দেয়া, পাকিস্তানিদের জন্য ভিসা বন্ধ এবং কূটনীতিকদের বহিষ্কারের মতো সিদ্ধান্তও রয়েছে। জবাবে পাকিস্তানও ভারতের বিরুদ্ধে একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে। জানানো হয়েছে, ভারত আর পাকিস্তানের আকাশসীমা ব্যবহার করতে পারবে না। সব ধরনের বাণিজ্য বন্ধ থাকবে। এছাড়া ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তিও স্থগিতের ঘোষণা করেছে পাকিস্তান। ভারতের দিক থেকে সিন্ধু চুক্তি স্থগিতের পরপরই অবশ্য পাকিস্তানের ভেতরে সিমলা চুক্তি স্থগিতের দাবি ওঠে। সিমলা চুক্তি স্থগিতের দাবি— পাকিস্তানি সাংবাদিক হামিদ মীর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স—এ একটা পোস্টে লিখেছেন, ‘পাকিস্তানে নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে। ভারত যদি বিশ্বব্যাংকের অধীন সিন্ধু পানি চুক্তিকে বিদায় জানাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়, তবে পাকিস্তানেরও সিমলা চুক্তি থেকে সরে আসা উচিত, যার মধ্যস্থতায় কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা অন্তর্ভুক্ত নেই।’ পাকিস্তান—শাসিত কাশ্মিরের সাবেক ‘প্রধানমন্ত্রী’ রাজা মহম্মদ ফারুক হায়দার খান সামাজিক মাধ্যম এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন, ‘ভারত একতরফাভাবে সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর জবাবে সিমলা চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। বিশেষত, কাশ্মির সংক্রান্ত বিষয়ে।’ পাকিস্তান সিমলা চুক্তি স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর দেশটির অনেক নাগরিক মনে করছেন, এতে তারা উপকৃত হবেন। এর পেছনে তারা যুক্তি দিয়েছেন, সিমলা চুক্তি পাকিস্তানকে কাশ্মির ইস্যুর আন্তর্জাতিকীকরণ থেকে বিরত রেখেছে। ওই চুক্তি স্থগিত হলে পাকিস্তান কোনোরকম কূটনৈতিক বাধ্যবাধকতা ছাড়াই আন্তর্জাতিক ফোরামে কাশ্মির ইস্যু উত্থাপন করতে পারবে। তবে সিমলা চুক্তির অধীনে থাকা অবস্থাতেও অবশ্য পাকিস্তান তা করেছে। কিন্তু পাকিস্তানি বিশ্লেষকদের মতে, সিমলা চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কাশ্মির ইস্যু ‘আরো জোর গলায়’ তুলে ধরতে পারবে পাকিস্তান। জাতিসঙ্ঘ কী বলেছে? সিমলা চুক্তি কী? — সিমলা চুক্তি এমন একটা আনুষ্ঠানিক চুক্তি ছিল যেটিকে দুই দেশের মধ্যে ‘শত্রুতা’ অবসানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়েছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারত—পাকিস্তান লড়াইয়ের পর ১৯৭২ সালের জুলাইতে স্বাক্ষরিত হয়েছিল এই চুক্তি। তার মাস ছয়েক আগেই পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। পাকিস্তানের সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৪৫ হাজার সৈন্য এবং আধাসামরিক বাহিনীসহ ৭৩ হাজার যুদ্ধবন্দী ভারতের কারাগারে ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় পাঁচ হাজার বর্গমাইল এলাকাও ভারতের দখলে ছিল। এই পটভূমিতেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলি ভুট্টো ভারতের হিমাচল প্রদেশের সিমলায় বৈঠক করছিলেন। সেখানে যে সমঝোতা হয় তার নাম সিমলা চুক্তি। চুক্তির দলিল স্বাক্ষরের তারিখ রেকর্ড করা হয়েছে, ১৯৭২ সালের দোসরা জুলাই। তবে বাস্তবে তেসরা জুলাই সকালে স্বাক্ষরিত হয়েছিল এই চুক্তি। দুই দেশের মধ্যে ‘শত্রুতার’ অবসানের পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সমঝোতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও সিমলা চুক্তির বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে মনে করা হয়েছিল। সিমলা চুক্তি অনুযায়ী, দুই দেশ দ্বিপক্ষীয় আলাপ—আলোচনার মাধ্যমে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে সব সমস্যার সমাধান করবে। সিমলা চুক্তির অধীনে দুই দেশের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলওসি) গঠিত হয়। সেই সময় ভারত—পাকিস্তান দু’পক্ষই এই নিয়ন্ত্রণ রেখাকে সম্মান জানাতে রাজি হয়। তারা এই বিষয়েও সম্মত হয়েছিল যে দু’পক্ষই কোনোরকম একতরফা সিদ্ধান্ত নেবে না। নিয়ন্ত্রণ রেখাকে স্কেল হিসেবে বিবেচনা করে একে অপরের ভূখণ্ড থেকে সেনা প্রত্যাহারে সম্মত হয়েছিল ভারত ও পাকিস্তান। কিন্তু দুই দেশই একে ওপরের বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রণ রেখাকে ‘না মানার’ অভিযোগ তুলে এসেছে। ‘মৃত চুক্তি’— গবেষণা প্রতিষ্ঠান অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (ওআরএফ) সিনিয়র ফেলো সুশান্ত সারিন পাকিস্তান বিষয়ক পর্যবেক্ষক। তার মতে, সিমলা চুক্তি থেকে পাকিস্তানের বেরিয়ে যাওয়া মোটেও ভারতের জন্য কোনো ‘ধাক্কা’ নয়। তিনি বলেছেন, ‘কাশ্মির ইস্যুতে বড় সিদ্ধান্ত নিতে বরং এটা ভারতকে সাহায্য করবে। মজার ব্যাপার হলো, পাকিস্তান অনেক আগেই সিমলা চুক্তি থেকে সরে এসেছে। পাকিস্তান কখনোই এই চুক্তিতে অটল থাকেনি।’ ‘পাকিস্তান যদি এই চুক্তি মেনে নিত, তাহলে তারা কার্গিলের যুদ্ধ করত না। প্রতিদিন আমরা সীমান্তের ওপার থেকে গুলি চালাই না এবং সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আশ্রয়ও দেই না। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তান যদি মৃত চুক্তির সৎকার করতে চায়, তাহলে তা করুক।’ কাশ্মিরি গবেষক ও আইনবিদ তথা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ফেলো মির্জা সায়ব বেগ অবশ্য ভিন্নমত পোষণ করেন। তার মতে, ‘সিমলা চুক্তি শুধু কার্যকর নয়, দুই স্বাক্ষরকারী দেশও তা বাস্তবায়ন করতেও বাধ্য।’ ‘সিমলা চুক্তি লঙ্ঘনের জন্য ভারতকে জবাবদিহি করাতে বা এই নিয়ে আন্তর্জাতিক কোনো দাবি না তুলতে পারাটা পাকিস্তানের অযোগ্যতা। সিমলা চুক্তিতে একতরফা সিদ্ধান্তের কোনো ধারণা নেই।’ তিনি জোর দিয়ে বলেন, পাকিস্তান তাদের অধিকারের অধীনে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিসে (আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত) ভারতের বিরুদ্ধে ওই চুক্তিকে লঙ্ঘনের অভিযোগ জানিয়ে মামলা করতে চেয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান কেন এমনটা করেনি সেটা তারাই জানে। পাকিস্তান কী বলছে?— পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী খুরশিদ মাহমুদ কাসুরিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে তার আমলে ভারতের সাথে আলোচনা সিমলা চুক্তির সীমারেখার মধ্যে থেকেই হয়েছিল কি না। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘এখন এই অঞ্চলের পরিস্থিতি সিমলা চুক্তির যুগ পার করে গেছে। গত দশকেও লাহোর চুক্তি, ইসলামাবাদ চুক্তির কথা মাথায় রেখে আলাপ আলোচনা এগোচ্ছিল। যে কারণে দুই দেশ আলাপ আলোচনা করছিল।’ ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন তিনি। তার কথায়, ‘সিমলা চুক্তিতে দ্বিপক্ষীয় ও শান্তিপূর্ণভাবে বিতর্কিত বিষয়গুলো সমাধানের কথা বলা হলেও ভারত একতরফা পদক্ষেপের মাধ্যমে কাশ্মিরের সাংবিধানিক মর্যাদা পরিবর্তন করেছে, যা এই দ্বিপক্ষীয় চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।’ ‘দু’দেশ সম্মত হয়েছিল যে তারা এলওসিকে সম্মান করবে।’ তবে পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতে, সিমলা চুক্তি বাতিল করা সম্ভব নয়। ভারতের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ তুলে তিনি বলেছেন, ‘মোদির পদক্ষেপে এই চুক্তি শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু আমি এটি বাতিল করতে পারি না। কারণ (সবসময়) সরকার এবং নীতি এক থাকে না।’ ভারতের ওপর প্রভাব পড়বে?— জম্মু ও কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল কি সিমলা চুক্তির লঙ্ঘন? এই প্রশ্নের উত্তরে দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সাউথ এশিয়া স্টাডিজের অধ্যাপক মহেন্দ্র পি লামা বলেছেন, ‘৩৭০ ধারা বিলোপের বিষয়টি সিমলা চুক্তির লঙ্ঘন ছিল না। ৩৭০ ধারা ভারতীয় সংবিধানের বিষয় ছিল এবং সংবিধান সংশোধন করার ক্ষমতা সংসদের রয়েছে।’ তার মতে, সিমলা চুক্তি স্থগিত হলে তার প্রভাব ভারতে পড়বে না। অধ্যাপক মহেন্দ্র লামা বলেন, ‘পাকিস্তান সিমলা চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেলে ভারতের ওপর তার কোনো প্রভাব পড়বে না। এমনিতেও পাকিস্তানকে মোকাবেলা করা যাবে এবং সেটা শুধু বলপ্রয়োগের মাধ্যমে, সিমলা চুক্তির মাধ্যমে নয়।’ ‘সিমলা চুক্তির এখন কোনো অর্থ নেই। পাকিস্তান প্রতিদিনই তা লঙ্ঘন করছে। সুতরাং এটা ভালো বিষয় যে তারা এখন চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসছে।’ সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিতের ‘জবাবে’ সিমলা চুক্তি স্থগিত সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে ভারতের পক্ষ থেকে সিন্ধু পানি চুক্তি এবং ‘তার জবাবে’ পাকিস্তানের পক্ষ থেকে সিমলা চুক্তি স্থগিত নিয়ে দুই দেশেই ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হলো দুই দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই দুই চুক্তির কতটা গুরুত্ব রয়েছে। পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন, ‘সিন্ধু পানি চুক্তি এবং সিমলা চুক্তি পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে তীব্র উত্তেজনার সময়ে সহযোগিতা এবং যোগাযোগের একটা ভিত্তি নিশ্চিত করার জন্য নিরাপত্তা জাল হিসেবে কাজ করেছিল।’ ‘তাদের সম্পর্কের ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে প্রবেশ করার আশঙ্কা রয়েছে।’ এখন প্রশ্ন হলো— সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিতের প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানের সিমলা চুক্তি থেকে সরে আসা কতটা উপযুক্ত জবাব? এই প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক মহেন্দ্র পি লামা বলছেন, ‘সিমলা চুক্তি ইতোমধ্যেই মৃত, অথচ সিন্ধু পানি চুক্তির প্রতিটা লাইন এখনো জীবিত। একটা মৃত চুক্তির সাথে একটা জীবন্ত এবং কার্যকর চুক্তির তুলনা হতে পারে না। পাকিস্তানের জনগণ সেই চুক্তি স্থগিত করার কথা বলছেন, যা তারা নিজেরা অনেক আগেই হত্যা করেছে।’ অধ্যাপক লামা বলছেন, ‘সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিতের ফলে পাকিস্তানের ওপর খুব খারাপ প্রভাব পড়বে। পাকিস্তানের জনসংখ্যার ৮০ শতাংশেরও বেশি প্রভাবিত হবে কারণ সিন্ধু নদের ৭০ শতাংশ পানি পাকিস্তানে যায়।’ ‘পাকিস্তানের কৃষিপণ্যের ৮০ শতাংশেরও বেশি সিন্ধু পানি চুক্তির পানির ওপর নির্ভর করে। এই পানি বন্ধ করা গেলে পাকিস্তানের মানুষকে বেশ সমস্যায় পড়তে হবে।’ সিন্ধু পানি চুক্তি ভাঙলে ভারতের সমস্যা হবে কি না সেই প্রসঙ্গেও মন্তব্য করেছেন তিনি। তার মতে, ‘এখন হয়তো সামাল দেয়া কঠিন হবে। কিন্তু এভাবেই একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়। ভারত পানির কিছু অংশ পরিচালনা করার ব্যবস্থা করেছে, তবে আগামী বছরগুলোতে এই ব্যবস্থা আরো বিস্তৃত হবে।’ সিনিয়র অ্যাডভোকেট রাজা মোহাম্মদ রাজ্জাক পাকিস্তান—শাসিত কাশ্মির সরকারের সচিব ছিলেন। তিনি এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন, ‘সিন্ধু পানি চুক্তি নিয়ে ভারত কোনো একতরফা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।’ তার মতে, এই বিষয়ে ভারতের ব্রহ্মপুত্রের বিষয়টা মাথায় রাখা উচিত। ‘চীন থেকে উৎপত্তি হয়ে ব্রহ্মপুত্র দুই দেশের মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। উত্তর—পূর্ব ভারত ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। ভারতের মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে চীনও।’ অধ্যাপক লামা অবশ্য বলছেন, ‘চীন যদি এমনটা করে, তাহলে বাংলাদেশের ওপর এর খুব খারাপ প্রভাব পড়বে। পাকিস্তানকে খুশি করতে দুই দেশকে চীন হয়রান করবে বলে আমি মনে করি না।’ ‘সিন্ধু তিব্বত থেকে উৎপন্ন হয়েছে এবং আমি মনে করি না চীন তিব্বতের পানির বিষয়ে সামাল দিতে পারবে। চীন ওই পানি যদি বন্ধ করে দেয় তাহলে সেটা পাকিস্তানে পৌঁছাবে না।’ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। সাম্প্রতিক আবহে ভারত—পাকিস্তান দুই পক্ষেরই ‘সর্বোচ্চ সংযম’ দেখানো উচিত বলে মনে করছে জাতিসঙ্ঘ। ভারত—পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। জাতিসঙ্ঘের মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন দুজারিক জানিয়েছেন, ‘গত ২৪ ঘণ্টায় দুই দেশের সরকারের সাথে সরাসরি যোগাযোগ না করলেও পরিস্থিতির ওপর কড়া নজর রাখা হচ্ছে।’ বৃহস্পতিবার আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পহেলগামে হামলার নিন্দা করা হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘দুই দেশই সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের চেষ্টা করতে হবে যাতে পরিস্থিতির আরো অবনতি না হয়।’ ‘আমরা বিশ্বাস করি, পারস্পরিক আলাপ—আলোচনার মাধ্যমে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যেকোনো সমস্যার শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা যেতে পারে।’ সূত্র : বিবিসি অপরদিকে পহেলগামের দোকানদাররা, রেস্তোরাঁগুলো প্রচুর খাবার জিনিস, মশলার স্টক করে রেখেছিল। পুরো টাকাটাই জলে গেলো বলে তারা মনে করছেন। কিভাবে তারা… শ্রীনগর বিমানবন্দর থেকে বেরোবার পরই বুঝলাম, পরিস্থিতি আলাদা হয়ে গেছে। কাশ্মিরে বহুবার এসেছি। ভোটের সময়ও দেখেছি। কিন্তু এবার এক ঝলক দেখেই বুঝা যাচ্ছে বদলে যাওয়া কাশ্মিরের চেহারা। রাস্তায় সেনা, পুলিশ, চেকিং আগের থেকে অন্তত দশগুণ বেশি। পুলিশের সাথে হাত মিলিয়ে সেনা জওয়ানরাও চেকিং করছেন। বিমানবন্দর থেকেই পহেলগাম যাওয়ার জন্য হাইওয়ে ধরলাম। পহেলগাম, অনন্তনাগ যেতে হলে সঙ্গম থেকে বাঁদিকে যেতে হয়। সেই সঙ্গমেই গাড়ি আটকে দেয়া হলো। বলা হলো, যেতে পারবেন না। সাংবাদিক হলেও নয়। এরপর সাহায্যে এগিয়ে এলেন স্থানীয় মানুষরা। তারা বললেন, আপনারা মেহমান। আপনারা যান। দেখে আসুন। বলে তারা ঘুরপথে কিভাবে যেতে হবে সেই রাস্তা দেখিয়ে দিলেন। অনন্তনাগ হয়ে পহেলগাম যেতে হলো। রাস্তায় শুধু নিরাপত্তা বাহিনী, সাঁযোয়া গাড়ি, দশগজ দূরে দূরে নিরাপত্তা কর্মী দাঁড়িয়ে। সামান্য জমায়েত দেখলেই পুলিশের গাড়ি সেখানে চলে আসছে। পহেলগামের অবস্থা দেখলে প্রথমে একটা কথাই মনে পড়বে, পুরো শহর স্তব্ধ। কোথাও কেউ নেই। হোটেল বন্ধ। ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে শুধু ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। কোনো মানুষ নেই। হোটেল মালিক মহম্মদ আলী বেগ জানালেন, ‘পহেলগামের সব হোটেল আগামী তিন মাসের জন্য বুকড ছিল। সব বুকিং ক্যানসেল হয়ে গেছে। জানি না, কিভাবে আমাদের দিন চলবে। আমরা তো এই তিন মাসের আয়ে সারা বছর চালাতাম।’ একই চিন্তা রেস্তোরাঁ মালিক, ট্যাক্সিচালকদের। তারাও বলছেন, চিন্তা হচ্ছে, আয় বন্ধ হয়ে গেলে চালাব কী করে? ট্যাক্সিচালক ফারুখ বলছিলেন, ‘কিছু ভাবতে পারছি না। এটা আমাদের চিন্তার বাইরে ছিল। এই তিন মাসই তো আমাদের আয়। সবে সিজন শুরু হয়েছিল। আমাদেরও সবকিছু শেষ হয়ে গেল।’ পহেলগামের দোকানদাররা, রেস্তোরাঁগুলো প্রচুর খাবার জিনিস, মশলার স্টক করে রেখেছিল। পুরো টাকাটাই জলে গেলো বলে তারা মনে করছেন। কিভাবে তারা ক্ষতিপূরণ করবেন, ঘুরে দাঁড়াবেন ভেবে পাচ্ছেন না। তারপরেও ট্যাক্সিচালকরা পর্যটকদের বলেছেন এবং বলছেন, ‘আপনারা মেহমান। এই সঙ্কটের সময়ে আপনারা যেখানে বলবেন, ছেড়ে দেবো। একটা পয়সাও নেব না।’ পর্যটকদের জন্য তারা ফ্রি সার্ভিস দিচ্ছেন। যেমন স্থানীয় মানুষরা পর্যটকদের জন্য লঙ্গর শুরু করেছিলেন। আমরা একটা রেস্তোরাঁয় খাওয়ার পর মালিক টাকা নিতে চাননি। বলেছেন, মেহমান আপনারা। টাকা লাগবে না।’ দুটো ছবি মেলাতে পারা যাচ্ছে না, যাবেও না। একদিকে বৈসরনে গত মঙ্গলবার অমানবিক, নৃশংস, বর্বরোচিত আক্রমণ, পর্যটকদের রক্তে ভেজা উপত্যকা, অন্যদিকে স্থানীয় মানুষদের এত কষ্টের মধ্যেও মানবিকতার হাত বাড়িয়ে দেয়া। শ্রীনগর থেকে পহেলগাম পর্যন্ত আমি একজন স্থানীয় মানুষ পাইনি, যিনি এই ঘটনার নিন্দায় মুখর হননি, যিনি ক্ষুব্ধ নন। ডাল লেকের বোটচালক থেকে শুরু করে, সহিস, সাধারণ মানুষ সকলেই প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন। মহম্মদ আলি বেগ বলছিলেন, ‘কয়েকজন সন্ত্রাসবাদী শুধু পর্যটকদের আক্রমণ করেনি, আমাদের উপরও হামলা করেছে, আমাদের পেটে লাথি মেরেছে, আমাদের রুটি—রুজি বন্ধ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র করেছে।’ ফারুখ বলছিলেন, ‘আমরাও চাই, দোষীদের কড়া শাস্তি হোক। নিরাপত্তা আরো বাড়ানো হোক। এটা শুধু পর্যটক নয়, কাশ্মিরিদের জন্যও জরুরি। বিশ্বাস করুন, আমরা চাই এরকম ঘটনা যেন আর না হয়। আবার পর্যটকে ভরে যাক পহেলগাম। আমাদের ঠিকভাবে বেঁচে থাকার জন্যও এটা জরুরি।’ সাধারণ মানুষের এই ভাবনার কথা পহেলগামে পা না রাখলে, তাদের সাথে কথা না বললে বুঝতে পারতাম না, বুঝা সম্ভব ছিল না। ২২ এপ্রিল বৈসরনে পর্যটকদের উপর সন্ত্রাসী হামলার পর এখন স্তব্ধ পহেলগামে শোকস্তব্ধ মানুষ। পর্যটকদের ওপর এ আঘাত কাশ্মিরের সাধারণ মানুষেরও ভয়াবহ ক্ষতি করে দিয়েছে। সূত্র : ডয়চে ভেলে অন্যদিকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেলুচিস্তানে বিক্ষিপ্ত সহিংসতা ঘটেছে, যেখানে বিভিন্ন উগ্রবাদী গোষ্ঠী প্রায়ই নিরাপত্তা বাহিনীকে লক্ষ্য করে হামলা চালায়। পাকিস্তানের দক্ষিণ—পশ্চিম বেলুচিস্তান প্রদেশে এক বিস্ফোরণে অন্তত চার আধা—সামরিক নিরাপত্তা কর্মী নিহত হয়েছেন। এছাড়া আরো তিনজন আহত হয়েছেন। শুক্রবার প্রাদেশিক রাজধানী কোয়েটার উপকণ্ঠে এই হামলা ঘটে। সরকারি সূত্রে জানা যায়, বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল বহনকারী একটি গাড়িকে লক্ষ্য করে একটি ইম্প্রোভাইজড বিস্ফোরক ডিভাইস ব্যবহৃত হয়। নগর পুলিশের এক সূত্র চীনা সংবাদ সংস্থা সিনহুয়াকে জানায়, ফ্রন্টিয়ার কর্পসের সদস্যরা এলাকায় নিয়মিত অভিযান পরিচালনার সময় তাদের গাড়িটি বিস্ফোরণের শিকার হয়। আহত সৈন্যদের চিকিৎসার জন্য নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ঘটনার পর নিরাপত্তা বাহিনী এলাকাটি ঘিরে ফেলে এবং দায়ীদের খুঁজে বের করতে তল্লাশি অভিযান শুরু করেছে। এই হামলার দায় এখনো পর্যন্ত কোনো গোষ্ঠী দায় স্বীকার করেনি। উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেলুচিস্তানে বিক্ষিপ্ত সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, যেখানে বিভিন্ন উগ্রবাদী গোষ্ঠী প্রায়ই নিরাপত্তা বাহিনীকে লক্ষ্য করে হামলা চালায়। সূত্র : সিনহুয়া, কাশ্মির হামলায় পাকিস্তানকে দোষারোপের প্রতিবাদে সিনেটে প্রস্তাব পাস করা হয়েছে। প্রস্তাবটিতে বলা হয়েছে, পানিসন্ত্রাস বা সামরিক উস্কানিসহ যেকোনো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পাকিস্তান তার সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষা করতে সম্পূর্ণরূপে সক্ষম ও প্রস্তুত। ভারতের—নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন পর্যটক নিহতের ঘটনায় পাকিস্তানকে দায়ী করেছে ভারত। ভারতের এ অভিযোগের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সিনেটে শুক্রবার সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। এর আগে বৃহস্পতিবার ইসলামাবাদে জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির (এনএসসি) বৈঠকে ভারতকে আহ্বান জানানো হয় যেন তারা প্রতিবারের মতো দোষ চাপানোর পুরোনো কৌশল ও রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য পেহেলগামের মতো ঘটনাবলিকে ব্যবহার করার প্রবণতা থেকে বিরত থাকে। পাকিস্তানের উপ—প্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার উত্থাপিত প্রস্তাবটিতে বলা হয়েছে, পানিসন্ত্রাস বা সামরিক উস্কানিসহ যেকোনো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পাকিস্তান তার সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষা করতে সম্পূর্ণরূপে সক্ষম ও প্রস্তুত। ওই প্রস্তাবে আরো বলা হয়েছে, নিরীহ নাগরিকদের হত্যা পাকিস্তানের নীতিমালার সম্পূর্ণ পরিপন্থী এবং এমন বর্বরতার বিরুদ্ধে পাকিস্তান বরাবরই সোচ্চার। সিনেট তার প্রস্তাবে ‘২২ এপ্রিল ভারত—নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মিরের পেহেলগাম হামলায় পাকিস্তানকে জড়ানোর ভিত্তিহীন ও কল্পনাপ্রসূত প্রচেষ্টা’ প্রত্যাখ্যান করেছে এবং নিন্দা জানিয়ে বলেছে, ‘পাকিস্তানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার জন্য ভারত সরকারের সুপরিকল্পিত ও কুৎসা রটনা এ অভিযান একটি সংকীর্ণ রাজনৈতিক লক্ষ্যে সন্ত্রাসবাদের বিষয়টিকে কাজে লাগানোর একটি পরিচিত ধরন অনুসরণ করে।’ সিনেট সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত রাখতে ভারতের বেআইনি ও একতরফা ঘোষণার নিন্দা করে বলেছে, এটি চুক্তির স্পষ্ট লঙ্ঘন এবং স্পষ্টতই যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। বুধবার হামলার পর দিল্লি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। ভারতের পদক্ষেপের মধ্যে ছিল ১৯৬০ সালের সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত করার একতরফা পদক্ষেপ। চুক্তিটি বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় হয়েছিল। এছাড়াও ভারত তার সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক হ্রাস করেছে।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2013-2022 dainikdristipat.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com