আন্তর্জাতিক ডেস্ক \ ইসলামাবাদ পেহেলগাম হামলায় তাদের কোনো সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছে এবং ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছে। বুধবার ভোরে ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তান ও পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মিরের বিভিন্ন স্থানে একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়, যাকে নাম দেয়া হয়েছে ‘অপারেশন সিন্দুর‘। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, তারা পাল্টা প্রতিশোধ নিয়েছে এবং একাধিক ভারতীয় সামরিক বিমান ভূপাতিত করেছে। পাকিস্তানের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ বিভাগ (আইএসপিআর)-এর মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরীর মতে, ছয়টি শহরে চালানো হামলায় অন্তত ২৬ জন পাকিস্তানি নিহত হয়েছেন। ভারত জানিয়েছে, তারা মোট নয়টি স্থানে হামলা চালিয়েছে। ভারত কেন পাকিস্তানে হামলা চালিয়েছিল?- ভারত-শাসিত কাশ্মিরের পেহেলগামে ২২ এপ্রিল পর্যটকদের ওপর চালানো ভয়াবহ হামলার প্রতিক্রিয়া হিসেবেই এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয় বলে দাবি করেছে ভারত। কাশ্মিরের স্বাধীনতার দাবিতে গঠিত সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ) পেহেলগাম হামলার দায় স্বীকার করেছে। ভারত দাবি করেছে, টিআরএফ আসলে পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়বা (এলইটি)-এর একটি শাখা। অন্যদিকে ইসলামাবাদ এ হামলায় তাদের কোনো সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছে এবং ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছে। তবে হামলার পর ভারত সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করে। পাকিস্তান তাদের পানিসম্পদের জন্য এই চুক্তির উপর নির্ভরশীল। এর জবাবে পাকিস্তান ১৯৭২ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে করা চুক্তি সিমলা স্থগিতের হুমকি দেয়। পাশাপাশি উভয় দেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক হ্রাস করে এবং একে অপরের নাগরিকদের বহিষ্কার করে। ভারত কিভাবে হামলার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেছে?- ভারত দাবি করেছে, তারা ‘উগ্রবাদীদের ঘাঁটি’ লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। ওই হামলার লক্ষ্য ছিল লস্কর-ই-তৈয়বা ও জইশ-ই-মুহাম্মদ (জেইএম)-এর ঘাঁটি। এগুলো পাকিস্তানভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠী। জেইএম ২০১৯ সালের ফেব্রæয়ারিতে পুলওয়ামায় আত্মঘাতী বোমা হামলার দায় স্বীকার করেছিল, যেখানে ৪০ জন ভারতীয় আধাসামরিক সৈন্য নিহত হন। বুধবারের ব্রিফিংয়ে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিসরি জানান, হামলার লক্ষ্য ছিল ‘উগ্রবাদীদের অবকাঠামো ধ্বংস ও ভারতে প্রবেশের সম্ভাবনা থাকা উগ্রবাদীদের নিষ্ক্রিয় করা।’ ব্রিফিংয়ে মিসরির সাথে থাকা ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তা কর্নেল সোফিয়া কুরেশি ও উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিং অভিযানের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন। তারা জানান, নয়টি হামলার মধ্যে পাঁচটি পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মিরে এবং বাকি চারটি পাঞ্জাবে- বাহাওয়ালপুর, মুরিদকে, শাকারগড় ও শিয়ালকোটের কাছে একটি গ্রামে। ব্রিফিং চলাকালে ভারতীয় সেনাবাহিনী একটি মানচিত্র প্রদর্শন করে, যেখানে পাকিস্তান ও পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মিরে ২১টি ‘উগ্রবাদী শিবির’ দেখানো হয়। তবে আল জাজিরা ভারত ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এসব দাবি স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি। পাকিস্তান আক্রমণের স্থানগুলো নিয়ে কী বলেছে?- আইএসপিআরের মুখপাত্র চৌধুরী ভারতীয় হামলাকে ‘নিরপরাধ মানুষকে লক্ষ্য করে বিনা উস্কানিতে চালানো আক্রমণ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ভারত পাকিস্তান ও পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মিরে ছয়টি স্থানে মোট ২৪টি হামলা চালিয়েছে। চৌধুরীর ভাষ্য মতে, নারী ও শিশুসহ অন্তত ২৬ জন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত এবং অন্তত ৪৬ জন আহত হয়েছেন। তিনি দাবি করেন, এই হামলায় মসজিদ ও আবাসিক এলাকাগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে, যার ফলে এসব প্রাণহানি ও ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। ভারতের লক্ষ্যবস্তু নির্বাচনের তাৎপর্য কী?- চারটি যুদ্ধের ইতিহাস থাকা এই দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে পাকিস্তানি ভূখÐে ভারতের এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলাগুলো সবচেয়ে বড় আকারের আক্রমণ। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর এই প্রথম পাকিস্তানের সর্বাধিক জনবহুল প্রদেশ পাঞ্জাবে হামলা চালিয়েছে ভারত, যা পাকিস্তানের জন্য ঐতিহাসিক ও অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পূর্ববর্তী বিমান হামলার তুলনায় এবার ভারত জনবহুল এলাকাগুলোকেও লক্ষ্যবস্তু করেছে। মুরিদকে শহরটি পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর লাহোরের পাশে অবস্থিত। শিয়ালকোট ও বাহাওয়ালপুরও বড় শহর। তবে ভারত যে স্থানগুলোকে টার্গেট করেছে, তার মধ্যে অনেকগুলোর কৌশলগত গুরুত্বও রয়েছে, অন্তত ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে। নিচে তাদের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হলো, মুরিদকে পাঞ্জাবের শেখুপুরা জেলার একটি শহর, যেখানে মুঘল, মৌয্য এবং গুপ্ত যুগের ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে। চৌধুরীর ভাষ্য মতে, মসজিদে উম্মুল কুরা নামের একটি মসজিদে চারটি হামলা চালানো হয়। এতে একজন নিহত ও একজন আহত হন। দু’জন নিখোঁজ রয়েছেন। এই হামলায় আশপাশের আবাসিক এলাকাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে ভারত ও আন্তর্জাতিক মহলের মতে, এই শহরেই অবস্থিত জামাত-উদ-দাওয়ার সদর দফতর, যা একটি দাতব্য সংস্থা হিসেবে পরিচিত হলেও নয়াদিল্লি জোর দিয়ে বলছে, এটি লস্কর-ই-তৈয়বার একটি শাখা সংগঠন। বুধবার ভারতের কুরেশি দাবি করেছেন যে ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্র মুরিদকেতে লস্কর-ই-তৈয়বার মারকাজ তাইবা শিবিরে আঘাত হেনেছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মতে, ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার মূল অভিযুক্তরা-যাদের মধ্যে আজমল কাসাবও ছিলেন-সেই শিবিরেই প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। এদিকে, মুরিদকে থেকে প্রাপ্ত ছবিতে দেখা যায়, উদ্ধারকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত সরকারি স্বাস্থ্য ও শিক্ষা কমপ্লেক্সের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে হতাহতদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন। বাহাওয়ালপুর, পাঞ্জাব : চৌধুরী জানান, বাহাওয়ালপুরের আহমেদপুর শারকিয়া শহরের মসজিদ সুবহানে চারটি ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে, যার ফলে মসজিদটি ধ্বংস হয়ে যায়। এই হামলায় অন্তত পাঁচজন নিহত হন- দুই পুরুষ, দুই নারী এবং তিন বছরের একটি মেয়ে। এছাড়া ৩১ জন আহত হন, যাদের মধ্যে ২৫ জন পুরুষ ও ছয়জন নারী। তিনি আরো বলেন, চারটি আবাসিক এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যেখানে সাধারণ মানুষ বসবাস করতেন। কুরেশি দাবি করেন, ভারত জইশ-ই-মুহাম্মদের সদর দফতর মারকাজ সুবহানাল্লাহ-তে হামলা চালিয়েছে। নয়াদিল্লির মতে, এই স্থানটি ছিল ‘নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও উগ্রপন্থা প্রচারের’ কেন্দ্র। মুজাফফরাবাদ, পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মির : মুজাফফরাবাদ পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মিরের রাজধানী, ঝিলাম ও নীলম নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত। এটি কুটির শিল্প যেমন আসবাবপত্র, কাঠ খোদাই, পোশাক এবং সূচিকর্মের জন্য পরিচিত। চৌধুরী জানান, মসজিদ-ই-বিলাল নামক একটি মসজিদে হামলা হয়েছে এবং এক শিশু মেয়ে আহত হয়েছে। অন্যদিকে, কুরেশি জানান, এলওসি থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সাওয়াই নালা ক্যাম্পে লস্কর-ই-তৈয়বার একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভারত হামলা চালিয়েছে। তিনি দাবি করেন, পেহেলগাম হামলাসহ একাধিক হামলার মূল পরিকল্পনাকারীরা এখানেই প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তারা বলেন, তারা মুজাফফরাবাদে জইশ-ই-মুহাম্মদের সৈয়দনা বিলাল ক্যাম্পেও হামলা চালিয়েছে। এই ধরনের ক্যাম্পগুলোকে বলা হয় ‘মঞ্চস্থ এলাকা’, যেখানে যোদ্ধা, যানবাহন ও সরঞ্জাম প্রস্তুত করে অভিযানের জন্য একত্রিত করা হয়। কোটলি, পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মির : কোটলি পুঞ্চ নদীর তীরে অবস্থিত একটি কৃষি ও পর্যটন কেন্দ্র। চৌধুরী বলেন, কোটলির মসজিদ আব্বাস লক্ষ্যবস্তু ছিল। এতে ১৬ বছরের এক মেয়ে ও ১৮ বছরের এক ছেলে নিহত হয় এবং আরো অন্তত দু’জন আহত হয়। কুরেশির মতে, ভারত এলওসি থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে গুলপুর ক্যাম্পে লস্কর-ই-তৈয়বার ঘাঁটিতে আঘাত করেছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী জানায়, তারা এলওসি থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে কোটলিতে অবস্থিত আব্বাস ক্যাম্পেও হামলা চালিয়েছে, যেখানে একসাথে ১৫ জন পর্যন্ত যোদ্ধা প্রশিক্ষণ নিতে পারে। তিনি আরো বলেন, ভারত মেহমুনা জোয়াতে হামলা চালিয়েছে, যা হিজবুল মুজাহিদিন (এইচইউএম)-এর একটি ঘাঁটি বলে জানা যায়। ১৯৮৯ সালে পাকিস্তানপন্থী আদর্শে বিশ্বাসী মুহাম্মদ আহসান দার এই গোষ্ঠীটি প্রতিষ্ঠা করেন, যার লক্ষ্য ছিল ভারতকে কাশ্মির ত্যাগে বাধ্য করা। ভিম্বর, পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মির : কুরেশি দাবি করেন, ভারত এলওসি থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে ভিম্বরের বার্নালা ক্যাম্পে হামলা চালিয়েছে। তার মতে, এই ক্যাম্পে যোদ্ধাদের অস্ত্র ব্যবহার, আইইডি তৈরির কৌশল এবং জঙ্গলে বেঁচে থাকার প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। তবে বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পাকিস্তানের কোনো কর্মকর্তা ভিম্বরকে আক্রমণের লক্ষ্যস্থল হিসেবে উল্লেখ করেননি। ভিম্বর কোটলির ঠিক দক্ষিণে অবস্থিত, তাই ধারণা করা হচ্ছে কোটলির হামলার অংশ হিসেবেই এটি গণ্য করা হচ্ছে। শিয়ালকোট, পাঞ্জাব : শিয়ালকোট পাকিস্তানের একটি প্রধান শিল্পাঞ্চল, যেখানে অস্ত্রোপচার যন্ত্র, ক্রীড়াসামগ্রী ও চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন হয়। চৌধুরী বলেন, শিয়ালকোটের উত্তরে কোটলি লোহারান নামের একটি গ্রামে দু’টি হামলা হয়। একটি ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে বিস্ফোরিত হয়নি এবং অন্যটি একটি খোলা মাঠে পড়ে, ফলে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে কুরেশি ও সিং দাবি করেন, ভারত শিয়ালকোটের সরজাল ক্যাম্পে হামলা চালিয়েছে, যেখানে মার্চ মাসে ভারত-শাসিত কাশ্মিরে চার পুলিশ সদস্য হত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। শকার গড়, পাঞ্জাব : চৌধুরী বলেন, শকার গড়ে দু’টি হামলা হয়েছে এবং একটি ছোট হাসপাতাল ও একটি ডিসপেনসারিতে সামান্য ক্ষতি হয়েছে। তবে ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তারা ৭ মে’র হামলার লক্ষ্যবস্তু হিসেবে শকার গড়ের উল্লেখ করেননি। সূত্র : আল জাজিরা