এফএনএস : দেশের মুদ্রাবাজারে বেড়েই চলছে তারল্য সঙ্কট। প্রায় সব ব্যাংকেই এ সঙ্কট ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। ফলে মুদ্রাবাজার থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান চার ব্যাংককেও ধার করতে হচ্ছে। অথচ ওই ব্যাংকগুলোই সঙ্কটের সময় দেশের মুদ্রাবাজারে ত্রাতার ভূমিকায় থাকতো। এমন অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক কলমানিসহ মুদ্রাবাজারের উত্তাপ কমাতে তৎপর হয়ে উঠেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা ধার দেয়া হচ্ছে। রেপো ও অ্যাসিউরড লিকুইডিটি সাপোর্ট (এএলএস) হিসাবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় ওই পরিমাণ অর্থ দিতে হচ্ছে। ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক কলমানি বাজারের সুদহার নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখছে। তারপরও সর্বোচ্চ ৫ শতাংশও সুদে কলমানিতে অর্থ লেনদেন হয়েছে। তবে সুদহার বেঁধে দেয়ায় কলমানিতে বিনিয়োগে ধারদাতা ব্যাংকগুলো এখন আর আগ্রহ দেখাচ্ছে না। কলমানির পরিবর্তে ব্যাংকগুলো এখন শর্ট নোটিসে দুই থেকে ১৪ দিন মেয়াদি ধার দিচ্ছে। সেক্ষেত্রে সুদহার ৮ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। মেয়াদ আরো বেশি হলে সেক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে ৯ শতাংশেরও বেশি সুদ গুনতে হচ্ছে। যদিও দেশের ব্যাংক খাতে এখন ঋণের সুদহারই সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ নির্ধারিত রয়েছে। সূত্র জানায়, রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংককে ঋণপত্রের (এলসি) দায় পরিশোধ করতে প্রতিদিনই বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বাজার থেকে ডলার কিনতে হচ্ছে। তাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো নগদ অর্থের সংকটে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে মুদ্রাবাজারে ধারদাতা প্রতিষ্ঠান থেকে ওই ব্যাংকগুলো এখন ধারগ্রহীতায় পরিণত হয়েছে। ডলার কিনতে গিয়ে অনেক বেসরকারি ব্যাংককেও একই পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছে। তবে বেশির ভাগ বেসরকারি ব্যাংকই আমানতের সুদহার কমিয়ে আনার খেসারত দিচ্ছে। ওসব ব্যাংক নামমাত্র সুদে কলমানি বাজার থেকে টাকা ধার করার নীতিতে চলছিল। কিন্তু ঈদুল ফিতরসহ নানা কারণে এখন অর্থের চাহিদা বাড়ায় ব্যাংকগুলোকে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত বা অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। গত বছরের জুনে অতিরিক্ত ওই তারল্যের পরিমাণ ২ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান চার ব্যাংক সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের হাতেই অতিরিক্ত ওই তারল্যের মধ্যে ৮৮ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা ছিল। তারপরও ওই ব্যাংকগুলোয় নগদ অর্থে টান পড়তে শুরু হয়েছে। সূত্র আরো জানায়, সরকারি বিভিন্ন সংস্থার এলসি দায় পরিশোধ করার জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে প্রতিদিনই বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাজার থেকে ডলার কিনতে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ঘোষিত দরের চেয়েও বেশি দামে ডলার কিনে এলসি দায় পরিশোধ করতে হচ্ছে। ওই কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত সবক’টি ব্যাংকেই নগদ তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে। যদিও বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪৩০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। তার মাধ্যমে বাজার থেকে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। মুদ্রাবাজারে চাপ সৃষ্টির পেছনে এটিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তহবিল ব্যয় কমাতে কিছু ব্যাংক কলমানি বাজার থেকে টাকা নিয়ে ঋণ দিয়েছে। ওসব ব্যাংকই এখন নগদ অর্থের সঙ্কটে পড়েছে। এদিকে এ প্রসঙ্গে ব্যাংকগুলোর ট্রেজারি কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ মানি মার্কেট ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বামডা) তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশের মুদ্রাবাজারে টাকা ধার দেয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানে আছে ব্যাংক এশিয়া। তাছাড়া আইএফআইসি, উত্তরা ও পূবালী ব্যাংকও ধারদাতা ব্যাংকের তালিকায় রয়েছে। বেসরকারি খাতের ওই ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকেও ধার করতে হচ্ছে। দেশের বেসরকারি খাতের বেশির ভাগ ব্যাংকই বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্য ব্যাংকগুলো থেকে ধার নিয়ে দৈনন্দিন লেনদেন সম্পন্ন করছে। এবি ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা, ঢাকা, এনআরবিসি, মেঘনা, সাউথ বাংলা, মিডল্যান্ডসহ নতুন-পুরনো আরো কয়েকটি ব্যাংকের তারল্য চাহিদা সবচেয়ে বেশি বলে জানা গেছে। অন্যদিকে বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, প্রয়োজনের নিরিখে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। ঈদসহ যেকোনো উৎসবের সময় মুদ্রাবাজারে নগদ তারল্যের চাহিদা বাড়ে। এই মুহূর্তে মুদ্রাবাজারে তারল্যের বাড়তি চাহিদা তারই প্রভাব। আশা করা যায় ঈদের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তবে ব্যাংকগুলোকে নিজেদের তহবিল ব্যবস্থাপনার প্রতি আরো বেশি যতœশীল ও সতর্ক হতে হবে।