এফএনএস : দেশের ধনী সমান চিকিৎসা করাতে বিদেশ যায়। নি¤œবিত্তের ভরসা সরকারি হাসপাতাল। কিন্তু শুধু চিকিৎসা ব্যয়েই নিঃস্ব হচ্ছে মধ্যবিত্ত। বেড়েই চলেছে স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তির নিজের পকেটের ব্যয়। এখন যে ব্যয় হয় তার প্রায় ৬৯ শতাংশই ব্যক্তি নিজে বহন করে। আর ওই ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে প্রতিবছর ৮৬ লাখের বেশি মানুষের আর্থিক অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছে। ব্যয় বেশি হওয়ার কারণে ১৬ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা নেয়া থেকে বিরত থাকে। অর্থাৎ ৩ কোটির বেশি মানুষ প্রয়োজন হলেও চিকিৎসকের কাছে বা হাসপাতালে যায় না। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের এক গবেষণার তথ্যানুযায়ী সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনে বাংলাদেশে প্রধান অন্তরায় হচ্ছে উচ্চ মাত্রায় ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় বা ‘আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার’। সেক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন থেকে বাংলাদেশ বহুদূর পিছিয়ে রয়েছে। আর সরকারিভাবে স্বাস্থ্য খাতকে সঠিক গুরুত্ব দিয়ে বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে না। ফলে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরকারি ব্যয়ে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। স্বাস্থ্য খাত সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে বাড়ছে অসংক্রামক জটিল রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা। ক্যান্সার, কিডনি, লিভার, স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। আর ওসব দুরারোগ্য ব্যাধির খরচ বহন করতে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। আপনজনকে বাঁচাতে নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দিচ্ছেন তারা। অনেকে প্রিয়জনকে বাঁচাতে ভিটেমাটি বিক্রি করেও অর্থ ব্যয় করছেন। কিন্তু পর্যাপ্ত সেবাটুকুও পাচ্ছে না তারা। রোগীর পরিস্থিতি সরকারি হাসপাতালে দীর্ঘলাইনে পড়ে আরো খারাপ হয়। জটিল অপারেশন সম্পন্ন হওয়ার রোগীর হাসপাতালের মেঝেতে থেকে বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশন দেখা দেয়। এমন অবস্থায় সেবা মিললেও বাঁচে না জীবন। তাছাড়া ওষুধের দাম নিয়ে শক্ত নীতিমালা না হওয়ায় বিভিন্ন ফার্মেসি বিভিন্ন রকম দাম রাখে। তার সঙ্গে ভেজাল ওষুধের দৌরাত্ম্য তো আছেই। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ এবং দূরদর্শী চিন্তার অভাবে মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস উঠছে। সূত্র জানায়, ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দেশে ভয়াবহ আকারে বেড়েছে। দুরারোগ্য রোগ ক্যান্সার দেশের বিপুলসংখ্যক পরিবারে কালো ছায়া ফেলেছে। ক্যান্সারের চিকিৎসা চালিয়ে নিতে রোগীর পরিবার বিপাকে পড়ছে। নিয়মিত ওষুধ, ডাক্তার ফি, কেমোথেরাপিসহ আনুষঙ্গিক খরচে তারা নাজেহাল। আর হারিয়ে যাচ্ছে প্রিয়জন। তাছাড়া আলসার, লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত রোগীরাও বিপাকে রয়েছে। ওষুধ আর ডায়ালাইসিসের খরচে কিডনি রোগীরা নিঃস্ব হচ্ছে। সরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করতে প্রতিবারে খরচ হয় ৫৬০ টাকা। আর কিডনি ফাউন্ডেশনে একবার ডায়ালাইসিসে খরচ হয় ৩ হাজার ৪০০ টাকা। গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে প্রতিবার ডায়ালাইসিসে ১ হাজার টাকা নেয়া হয়। তবে দরিদ্রদের কাছ থেকে হাসপাতালটি ৪৬০ টাকা নিয়ে থাকে। আর পাঁচতারকা হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করতে খরচ হয় প্রায় ৫ হাজার ৩০০ টাকা। এদিকে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বাস্থ্য খাতে সরকারের বরাদ্দ অপ্রতুল। চিকিৎসা ব্যয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ খরচই মানুষের নিজের পকেট থেকে করতে হয়। এমন অবস্থায় শুধু বরাদ্দ বাড়ানোই নয়, অনুন্নত স্বাস্থ্য খাতেও পরিবর্তন জরুরি। দেশের একটি ইউনিয়নে ৫০ হাজারের মতো মানুষ বসবাস করলেও তাদের জন্য একজন চিকিৎসকের ব্যবস্থাও নেই। সেজন্য ইউনিয়ন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করা জরুরি। সেখানে কমপক্ষে ৪ জন চিকিৎসক নিয়োগ দিতে হবে। তার মধ্যে একজন দন্ত চিকিৎসক এবং মনোচিকিৎসক রাখা প্রয়োজন। পাশাপাশি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে এক্সরে, আলট্রাসনো মেশিন থাকতে হবে। তার সঙ্গে নিয়োগ দিতে হবে নার্স এবং টেকনোলজিস্ট। ওই স্বাস্থ্যকর্মীদের আবাসনের ব্যবস্থাও সেখানেই করতে হবে এবং তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ এবং প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলেই ইউনিয়নের রোগী সেখানেই প্রয়োজনীয় সেবা পাবে। আর বিশেষায়িত সেবার জন্য রোগী চিকিৎসকের পরামর্শে জেলা, বিভাগ কিংবা রাজধানীতে আসবে। অন্যদিকে এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চেšধুরী জানান, দেশে অসংক্রামক রোগ ক্যান্সার, কিডনি, লিভারের বিভিন্ন সমস্যায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ওসব রোগের দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে পরিবার। দুরারোগ্য ওসব ব্যাধির খরচ রোগীর নিজের পকেট থেকেই বেশির ভাগ বহন করতে হয়। তাতে রোগ-শোক পরিবারের ওপরে বোঝা হয়ে দেখা দিচ্ছে। খরচ মেটাতে নিঃস্ব হচ্ছে মানুষ। সেজন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে অনেক সাফল্য আছে। কিন্তু বরাদ্দ প্রয়োজন অনুযায়ী না বাড়লে ওই সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।