এফএনএস : দেশের অর্ধেকেরও বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্বাস্থ্যকর পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই। অথচ স্বাস্থ্যকর পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা শিশুর সুস্বাস্থ্য ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বিকাশের অন্যতম অপরিহার্য পূর্বশর্ত। কিন্তু দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় অধ্যয়নরত শিশুদের জন্য এখনো ওই সুবিধা পুরোপুরি নিশ্চিত হয়নি। জাতিসংঘের শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) তথ্যানুযায়ী দেশের প্রায় অর্ধেকের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এখনো স্বাস্থ্যকর পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়নি। যদিও যে কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পয়োনিষ্কাশন সুবিধা নিশ্চিতে ছেলে ও মেয়েদের আলাদা এবং ব্যবহার উপযোগী শৌচাগার থাকা আবশ্যক। তার সঙ্গে আরো বেশকিছু মৌলিক পরিষেবার উপস্থিতি অপরিহার্য। সেগুলো হলো পাইপলাইনযুক্ত নির্গমন ব্যবস্থার সমন্বিত শৌচাগার, সেপটিক ট্যাংক বা পিট ল্যাট্রিন, বায়ু চলাচল উপযোগী উন্নত পিট ল্যাট্রিন ও পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রবহমান পানির (রানিং ওয়াটার) উপস্থিতি। কিন্তু দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর ৫২ শতাংশেই ওসব পরিষেবার কোনো না কোনোটির অনুপস্থিতি রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, স্বাস্থ্যসম্মত পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার অনুপস্থিতি শিশুর নানা স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হয়ে উঠতে পারে। দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করার জন্য পয়োনিষ্কাশন ও মৌলিক পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থা থাকা জরুরি। কিন্তু দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় মৌলিক ওসব সুবিধা না থাকায় শিক্ষার্থীদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা খুবই দুর্বল থেকে যাচ্ছে। তারা বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ। পয়োনিষ্কাশন ও পরিচ্ছন্নতা হলো সুস্বাস্থ্যের পূর্বশর্ত। মৌলিক পয়োনিষ্কাশন ও পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থা না থাকলে শিশুরা সহজেই রোগাক্রান্ত হয়ে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কা থাকে। আর এ সমস্যা সমাধানের জন্য অবকাঠামোভিত্তিক স্যানিটেশন ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শিশু ও নারীদের জন্য স্যানিটেশন ব্যবস্থায় সঠিক অবকাঠামো দেখা যায় না। তাছাড়া পর্যাপ্ত পরিমাণে নিরাপদ সুপেয় পানির উপস্থিতি ও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে হাত ধোয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও থাকাও জরুরি। সূত্র জানায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী এদেশে গৃহস্থালি এবং বিদ্যালয়ের মধ্যে তুলনামূলকভাবে গৃহস্থালির স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভালো। আর প্রাথমিকের চেয়ে সব ক্ষেত্রে মাধ্যমিক বিদ্যালয় এগিয়ে রয়েছে। ৭৮ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সুপেয় পানির ব্যবস্থা রয়েছে আর মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে ওই হার ৯৩ শতাংশ। তাছাড়া ৫১ শতাংশ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মৌলিক পরিচ্ছন্নতা বা বেসিক হাইজিন ব্যবস্থা নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভাষ্য অনুযায়ী, স্যানিটেশন ব্যবস্থা বলতে মানবদেহের বর্জ্য নিরাপদ নিষ্কাশনের যথাযথ ব্যবস্থা এবং সুবিধার উপস্থিতিকে বোঝায়। সূত্র আরো জানায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পয়োনিষ্কাশনের সঙ্গে শিশুর ডায়রিয়া ও খর্বকায়ত্বের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। অনুন্নত পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার কারণে ডায়রিয়া, অন্ত্রের প্রদাহ ও কৃমির মতো সমস্যা দেখা দেয়। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসম্মত পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও পরিচ্ছন্নতার ঘাটতির কারণে বছরে ৪২০ কোটি ডলার ক্ষতি হয়। ওই অর্থ দেশের জিডিপির ৬ দশমিক ৩ শতাংশের সমান। তবে উন্মুক্ত জায়গায় মল ত্যাগ বন্ধে বাংলাদেশ উলেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করলেও স্বাস্থ্যকর পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়নি। মৌলিক পরিচ্ছন্নতা বা হাইজিন সম্পর্কে মানুষের ধারণা ভালো থাকলেও সঠিকভাবে হাত ধোয়ার অভ্যাস খুবই কম। এদিকে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক শৌচাগার থাকা জরুরি। কারণ স্যানিটেশনের সমস্যা থাকলে তাতে সংক্রামক রোগগুলো বেশি বিস্তার লাভ করে। কৃমি, টাইফয়েড, কলেরা ও পেটে পীড়াসহ বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়। চর্ম রোগ হয়। স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভালো না হওয়ার কারণে স্কুলগামী শিশুদের ওই রোগগুলো বেশি হয়। একই সঙ্গে শিশুরা রোগের কষ্ট পেলেও অভিভাবকের কাছে সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারে না। ফলে রোগগুলো বড় আকার ধারণ করে। ওসব কারণে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে না। আর তাতে বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার হারও বাড়তে থাকে। বর্তমানে দেশে মোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৫৬৬। আর সরকারি, বেসরকারি, ইবতেদায়ি মাদ্রাসা, এনজিও স্কুল, শিশু কল্যাণ বিদ্যালয়সহ প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১ লাখ ৩৩ হাজার। সেগুলোয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২১ লাখ ৫৫ হাজারেরও কিছু বেশি। অন্যদিকে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ইউনিসেফের তথ্যের সঙ্গে একমত নন। তাদের মতে, প্রাথমিক পর্যায়ের বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য বর্তমানে কয়েকটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। তার মধ্যে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর পয়োনিষ্কাশন ও নিরাপদ পানি সরবরাহের স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করছে। এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. সুশান্ত রায় জানান, বর্তমানে চতুর্থ প্রাথমিক বিদ্যালয় উন্নয়ন প্রকল্পসহ তিনটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্যানিটেশন এবং পানীয় জলের ব্যবস্থার জন্য অবকাঠামোর কাজ করছে। এরইমধ্যে সাড়ে ৩৯ হাজার বিদ্যালয়ে নিরাপদ পানির উৎসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। একই সঙ্গে স্যানিটেশন ব্যবস্থার আওতায় এসেছে ২৮ হাজার বিদ্যালয়। অনেক বিদ্যালয়ে আগে থেকেই সুপেয় পানি ও পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা ছিল। ২০২৩ সালে চলমান প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। দেশে শতভাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনের আওতায় আনার কার্যক্রম এখন শেষ পর্যায়ে রয়েছে। সার্বিক বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন) ড. উত্তম কুমার দাশ জানান, ইউনিসেফ সরকারি ও বেসরকারি সব ধরনের প্রাথমিক বিদ্যালয়কে নিয়ে এ প্রতিবেদন করায় সংখ্যাটি এমন হতে পারে। কিন্তু প্রায় শতভাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ওয়াশ ব্লক করে নিরাপদ পানীয় জল এবং স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।