এফএনএস : আইনে কড়াকড়ি থাকলেও সাইবার অপরাধ দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলেছে। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি), তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের সাইবার হেল্প ডেস্ক ও ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারে (এনটিএমসি) সাইবার অপরাধ নিয়ে প্রতিদিনই অভিযোগ জমা পড়ছে। কিশোর-তরুণরাই সাইবার অপরাধে বেশি জড়াচ্ছে আর মেয়েরা বেশি শিকার হচ্ছে। এ্যাপস বন্ধ করেও সাইবার অপরাধ ঠেকানো সম্ভব নয়। এমন পরিস্থিতিতে প্রযুক্তির অপব্যবহার ঠেকাতে অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রীয়ভাবে কঠোর নজরদারির প্রয়োজন। একই সাথে পুলিশের সক্ষমতা আরো বাড়ানো জরুরি। সাইবার অপরাধ থেকে রক্ষা পেতে অপরিচিত কাউকে বন্ধু না বানানো, অপরিচিত বা সন্দেহজনক লিংকে প্রবেশ না করা, কারও সঙ্গে পাসওয়ার্ড শেয়ার না করা এবং সচেতনতার বিকল্প নেই। তারপরও কেউ অপরাধের শিকার হলে দ্রুত থানা ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে প্রমাণসহ জানাতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তিবিদ এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, এদেশে এখনো পরিকল্পিত সাইবার অপরাধের মামলা অনেক কম। গত ৭ বছরে ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য আসা মামলার মাত্র ৪ দশমিক ২৩ শতাংশ হ্যাকিং, কম্পিউটারের সোর্স কোড পরিবর্তনের মতো গুরুতর অভিযোগ ছিল। তার মধ্যে হ্যাকিংয়ের মামলাগুলোর বড় অংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক হ্যাকিংয়ের অভিযোগে করা হয়। তাছাড়া বিকাশ, নগদ, রকেটের মতো আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকের এ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ের ঘটনায়ও মামলা হয়েছে। তার বাইরে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট হ্যাকিংয়ের অভিযোগের মামলাও ট্রাইব্যুনালে এসেছে। মূলত অনলাইনে মানহানি, মিথ্যা তথ্য, অশ্লীল ছবি ও তথ্য প্রকাশের অভিযোগে সাইবার অপরাধের মামলা বেশি হচ্ছে। ওই তুলনায় হ্যাকিংসহ অন্য গুরুতর অপরাধের মামলা কম, সাজাও নগণ্য। সেজন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা হয়রানি ও সম্মানের কথা ভেবে সাইবার অপরাধ বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কাছে অভিযোগ করে না। তাছাড়া স্বচ্ছ ধারণা না থাকা ও প্রতিকার পেতে সময়ক্ষেপণ হওয়ায় আইনের আশ্রয় নিতে বেশি অনীহা। সূত্র জানায়, কিশোর-তরুণরা সাইবার অপরাধে বেশি জড়াচ্ছে। ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি, ইমো হ্যাকের পর ব্ল্যাকমেল করে অর্থ আদায়, ধর্ষণ এবং এর ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার মতো সাইবার অপরাধ দিন দিন বাড়ছে। তাছাড়া শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইটের তথ্য জালিয়াতি করে জাল সনদ তৈরি, গুরুত্বপূর্ণ ও ভিআইপি ব্যক্তিদের নামে ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের প্রতারণার ঘটনাও ঘটছে। ফেসবুক, হোয়াটসএ্যাপ, মেসেঞ্জার, ইনস্টাগ্রাম, স্কাইপে ভুয়া আইডি খুলে জালিয়াতি ও প্রতারণা, বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে মিথ্যা ও মানহানিকর তথ্য প্রচার, আইডি হ্যাক, ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি, অনলাইনে প্রশ্নপত্র ফাঁস, অনলাইনে জুয়া খেলাসহ অন্তত ১৩ ধরনের সাইবার অপরাধ ঘটছে। আইনে কড়াকড়ি আরোপ করাসহ নানা পদক্ষেপ নেয়া সত্তে¡ও ওসব অপরাধ কমছে না। শুধু আইডি হ্যাক করে কিংবা ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি করেই নয়; ভিআইপি ব্যক্তিদের নামে তথা পুলিশের আইজি পরিচয়ে, মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) পরিচয়ে প্রতারণা, নারী পুলিশের আপত্তিকর ছবি ছড়ানো, পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণা, গৃহবধূকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার অপরাধের ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছে অপরাধীরা। সূত্র আরো জানায়, সাইবার অপরাধে নারীরাই বেশি শিকার হচ্ছে। আ নারীদের সেবা প্রদানের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয় পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ওই সেলে গত এক বছরে ১২ হাজার ৬৪১ জন নারী ভুক্তভোগী সাইবার স্পেসে হয়রানি সংক্রান্ত যোগাযোগ করেছে। পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সাইবার স্পেসে হয়রানির শিকার ১২ হাজার ৬৪১ জন ভুক্তভোগীর মধ্যে মাত্র ১২ শতাংশ জিডি বা মামলা করেছে। তার মধ্যে মাত্র ১৩ শতাংশ ভুক্তভোগী অভিযুক্তের পরিচয় ও অবস্থান শনাক্তে পর অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সেলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৭ হাজার ২৮০ জন সেবাপ্রত্যাশী যোগাযোগ করেছে। তার মধ্যে হয়রানি সংক্রান্ত ১২ হাজার ৬৪১ অভিযোগের মধ্যে ৮ হাজার ২২১ জনকে প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রযুক্তিগত ও আইনগত পরামর্শ ও সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। সাইবার অপরাধে ভুয়া আইডি ব্যবহার করে হয়রানি করার অভিযোগই সবচেয়ে বেশি। অভিযোগকারীর শতকরা ১৬ ভাগ ভুক্তভোগী ১৮ বছরের কম বয়সী। শতকরা ৫৮ ভাগ ভুক্তভোগীর বয়স ১৮ থেকে ২৪ বছর। ২৫-৩০ এর মধ্যে ভুক্তভোগী ২০ ভাগ এবং ৬ ভাগ ভুক্তভোগীর বয়স ৪০ বছরের বেশি। তাছাড়া সিআইডি, ডিএমপির সাইবার সেন্টারে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ দিন দিন বাড়ছে। ১৮ বছর বয়সী ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ৭ শতাংশ, ১৯ থেকে ২৫ বছর বয়সী ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ৩৪ শতাংশ, ২৬ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ৩৬ শতাংশ, ৩৬ থেকে ৫৫ বছর বয়সী নারী-পুরুষের মধ্যে ২০ শতাংশ এবং ৫৫ থেকে বেশি বয়সী নারী-পুরুষের মধ্যে ৩ শতাংশ তথ্য-প্রযুক্তির অপব্যবহার করে অপরাধে জড়াচ্ছে। সিটিটিসি সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগে প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০-৪০টি মৌখিক ও লিখিত সাইবার সম্পর্কিত অভিযোগ আসছে। তার মধ্যে ব্ল্যাকমেলিং, মোবাইল ব্যাকিং ও পর্নোগ্রাফির অভিযোগ বেশি। এদিকে তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের মতে, অপরাধ ঠেকাতে এ্যাপস বন্ধ করা যেমন কঠিন, তেমনি সেগুলো নিষিদ্ধ করেও লাভ নেই। নিষিদ্ধ করে ব্যবহার ঠেকানো যায় না। বরং সেজন্য দুইটি বিষয়ে জোর দেয়া প্রয়োজন। সাইবার অপরাধ দমনে পুলিশের সক্ষমতা আরো বাড়ানো এবং দরকার প্যারেন্টাল গাইডেন্স। সন্তান যে গ্যাজেটটি ব্যবহার করছে তার প্যারেন্টাল কন্ট্রোল অন করে দিতে হবে। ফলে সন্তান যদি কোন নিষিদ্ধ এ্যাপ ব্যবহার করে, সাইটে ঢোকে বা গ্র“পে তৎপর হয় তাৎক্ষণিকভাবে তিনি তার নোটিফিকেশন পাওয়া যাবে। অন্যদিকে বিটিআরসি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিটিআরসি শুধু ইউটিউব, ফেসবুকের কোন কনটেন্ট সরানোর অনুরোধ করতে পারে। কনটেন্ট বিটিআরসির কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড পরিপন্থী হলে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ তা অপসারণ করে, নয়তো করে না। আর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী বা সরকারের পক্ষে ইন্টারনেট জগতে কোন কিছু পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।