মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:৩৪ পূর্বাহ্ন

পি কে হালদার তিন দিনের রিমান্ডে

দৃষ্টিপাত ডেস্ক :
  • আপডেট সময় সোমবার, ১৬ মে, ২০২২

এফএনএস : হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাত ও পাচার করে পলাতক প্রশান্ত কুমার হালদারকে (পিকে হালদার) ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে গ্রেফতারের পর তিনদিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। শনিবার গভীর রাতে ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) থেকে পিকে হালদারের রিমান্ড আবেদন করা হয়। রবিবার সকালে রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। এদিকে বন্দী বিনিময় চুক্তির আওতায় পিকে হালদারকে দেশে এনে বিচারের মুখোমুখি করা হবে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা এ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। আইনী ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) কর্মকর্তারা দেশটির গণমাধ্যমে বলেছেন, দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত ২০১৬ সালের প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় পিকে হালদারকে বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে। বাংলাদেশে আর্থিক খাতে আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদারকে (পিকে হালদার) ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে গ্রেফতারের পর তিনদিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশপরগনা জেলা থেকে পিকে হালদারকে গত শনিবার দুপুরের দিকে গ্রেফতার করা হয়। এর পর আদালতে রিমান্ডের আবেদন করা হলে তা মঞ্জুর করা হয়। শনিবার গভীর রাতে স্পেশাল ইডি থেকে পিকে হালদারের রিমান্ড আবেদন করা হয়। রবিবার সকালে রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। পিকে হালদারের পাঁচ সহযোগীর মধ্যে চারজনের তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। পরে আদালতের বিচারকরা পিকে হালদারকে মঙ্গলবার পর্যন্ত ইডি হেফাজতে পাঠিয়ে দেন। এর আগে পশ্চিববঙ্গের বিভিন্ন স্থানে পিকে হালদারের প্রাসাদোপম বাড়িসহ অনেক সম্পদের সন্ধান পায় ইডি। সংস্থাটি পিকে হালদার ও তাঁর সহযোগীদের সম্পদের সন্ধানে গত দুইদিনে অন্তত ১০টি স্থানে অভিযান চালিয়েছে। প্রধানত আর্থিক কেলেঙ্কারি, বেআইনীভাবে ভারতে অর্থ পাঠানো, বিদেশে অর্থ পাচার এবং আইনবহির্ভূত সম্পত্তির বিষয়ে তদন্ত করছে ইডি। অবশ্য এ পর্যন্ত কত বাড়ি, জমি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের হদিস পাওয়া গেছে, তার পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া যায়নি। ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) কর্মকর্তারা বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলেছেন, দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত ২০১৬ সালের প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় পিকে হালদারকে বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে। দেশটির কেন্দ্রীয় এই তদন্ত সংস্থা বলছে, তারা অভিযানের সময় পিকে হালদারের কাছ থেকে সম্পত্তি এবং জমির দলিলসহ কিছু মূল কাগজপত্র জব্দ করেছেন। এসব নথিতে প্রাথমিকভাবে ভারতে তার ২০ থেকে ২২টির মতো বাড়ির মালিকানার তথ্য মিলেছে। হালদার ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতে পৌঁছান বলে সংস্থাটি জানতে পারে। ভুয়া ভারতীয় ভোটার, প্যান এবং আধার কার্ড সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। শিব শঙ্কর হালদার নামে উত্তর চব্বিশপরগনার অশোকনগরে বিপুল সম্পত্তি গড়েছেন তিনি। ইডির এক কর্মকর্তা বলেছেন, তার সহযোগীরাও একই ধরনের ভুয়া ভারতীয় ভোটার, প্যান ও আধার কার্ড সংগ্রহ করে অশোকনগরে নিজেদের ব্যবসা পরিচালনা করছিলেন। ভারতীয় এই গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা বলেছেন, পিকে হালদারকে বাংলাদেশে হস্তান্তরের পেছনে দুটি বিষয় রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো, বাংলাদেশের আর্থিক ইনটেলিজেন্স ইউনিট ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুরোধ, অন্যটি তার বিরুদ্ধে যেসব মামলা রয়েছে সেগুলো বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে সংশি−ষ্ট। এর আগে ইডির এক বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশী নাগরিক প্রশান্ত কুমার হালদার, প্রীতিশ কুমার হালদার, প্রাণেশ কুমার হালদার এবং তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। প্রশান্ত কুমার হালদার নিজেকে শিব শঙ্কর হালদার নামে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিতেন। এদিকে বন্দীবিনিময় চুক্তির আওতায় পিকে হালদারকে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে বলে জানিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান মঈনউদ্দিন আবদুল−াহ। রবিবার সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আমাদের দেশে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি ও আইন রয়েছে। ভারতের সঙ্গে আমাদের বন্দী বিনিময় চুক্তি রয়েছে। আমরা এখন মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পারলাম। অফিসিয়ালভাবে জানতে হবে। জানার পরে যোগাযোগ করব। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও জননিরাপত্তা বিভাগসহ সবাই মিলে এক সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে। তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে আনঅফিসিয়াল যোগাযোগ রাখছি। কিছু তথ্য লেনদেন হচ্ছে। ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে আনঅফিসিয়ালি কিছু করা যায় না। মিডিয়ায় আসার পর আমরা তথ্য নেয়ার চেষ্টা করেছি। তবে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে এখনও অফিসিয়ালি কিছু শুরু করিনি। আমরা দেখি ভারত সরকারীভাবে কী জানায়? ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড এলার্ট জারি করা ছিল, এটি পি কে হালদারকে ফিরিয়ে আনতে বাড়তি কোন সুবিধা দেবে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের সঙ্গে ভারতের বন্দী বিনিময় চুক্তিই আছে। আনতে হলে চুক্তির আওতায় আনা হবে। ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড এলার্ট ভারতসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও দেয়া হয়েছে। রেড এলার্ট জারির পর ভারত সময়ে সময়ে বেশকিছু তথ্য চেয়েছিল। আমরাও দিয়েছি। অন্যদিকে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম পি কে হালদার প্রসঙ্গে বলেন, তদন্তাধীন মামলায় দুর্নীতি দমন কমিশন পিকে হালদারকে অবশ্যই রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। তখন দেখা যাবে এখানে অনেক রুই-কাতলা জড়িত। তাদেরও ধরা সহজ হবে তখন। সে কানাডা থেকে ভারতে চলে আসার বিষয়ে দুদকের কাছে কোন তথ্য ছিল না। তবে তার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড এ্যালার্ট ছিল। তবে কোন বন্দীকে ফেরত আনার ব্যাপারে সরকার ‘আনুষ্ঠানিকভাবে যথাযথ মাধ্যমে’ সেই দেশের সরকারকে চিঠি দেয়। চিঠি পাওয়ার পর সেই দেশের সরকার বিবেচনা করবে। পরে বিনিময়ের মতো হলে তারা বন্দীকে ফেরত দেবে। পি কে হালদারের বিষয়ে অন্য কোন জটিলতা না থাকলে আনুষ্ঠানিকতা শেষে তিন মাসের মধ্যে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন দুদকের উর্ধতন কর্মকর্তারা। ২০১৩ সালের অক্টোবরে ভারতের সঙ্গে বহির্সমর্পণ চুক্তি করে বাংলাদেশ। এ চুক্তির আওতায় দুই দেশ বন্দী বিনিময় করার সুযোগ পাবে। এ চুক্তি হওয়ার আগে অনানুষ্ঠানিকভাবে সীমান্ত পার করিয়ে দুই দেশের মধ্যে বন্দী বিনিময় হতো। বাংলাদেশের কারাগারে থাকা ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার নেতা অনুপ চেটিয়াকে ভারত চাওয়ার পর থেকে এই বন্দী বিনিময় বা বহির্সমর্পণ চুক্তির বিষয়টি সামনে আসে। তবে সাধারণত বন্দী ফেরত দেয়ার ব্যাপারে সংশি−ষ্ট দেশ বন্দীর বিরুদ্ধে আদালতের দেয়া সাজা দেখতে চায়। ২০২১ সালের ৮ জানুয়ারি দুদকের অনুরোধে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা দিয়ে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড এ্যালার্ট জারি করা হয়েছিল। ২০১৯ সালের মাঝামাঝিতে যখন ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের গ্রাহকরা অর্থ ফিরে পেতে অভিযোগ করতে থাকেন তখনই দুদকের অনুসন্ধান শুরু হয়। সংস্থাটির একাধিক কর্মকর্তার অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে পিকে হালদারের আর্থিক দুর্নীতির নানা তথ্য। একই সঙ্গে তার বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটও। আত্মসাতের ক্ষেত্রে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, ব্যাংক কর্মকর্তা ও নিজস্ব বাহিনীকে কাজে লাগিয়েছেন পিকে হালদার চক্র। দুদকসহ বিভিন্ন সংস্থার তথ্যানুসারে পিকে হালদার ও তার সঙ্গীরা মিলে অন্তত ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা আত্মসাত করেছেন। যা বিভিন্ন উপায়ে হস্তান্তর, স্থানান্তর ও রূপান্তরের মাধ্যমে পাচার করা হয়েছে। অনুসন্ধানের সময় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পিকে হালদারের লাগামহীন দুর্নীতির নথিপত্র সংগ্রহ করে দুদক। এসব নথিতে দেখা যায়, এ ব্যক্তি অস্তিত্বহীন ৩০-৪০টি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে ঋণের নামে জালিয়াতি করে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং এ্যান্ড ফাইন্যান্স, এফএএস ফাইন্যান্স এ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেড ও পিপলস লিজিং এ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস থেকে আত্মসাত করেছেন প্রায় ১০ হাজার ২শ’ কোটি টাকা। এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে দুই হাজার ৫০০ কোটি, এফএএস ফাইন্যান্স থেকে প্রায় দুই হাজার ২০০ কোটি, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স থেকে প্রায় দুই হাজার ৫০০ কোটি ও পিপলস লিজিং থেকে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। এসব ঋণের বিপরীতে মর্টগেজ (জামানত) নেই বললেই চলে। পি কে হালদারের গ্রেফতারের বিষয়ে রবিবার সুপ্রীমকোর্টের নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধেই ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সরকার পিকে হালদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থা তাদের জানিয়েছিল অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি সেখানে অবস্থান করছেন। সে তথ্যের ভিত্তিতে পি কে হালদারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এখন তাকে বাংলাদেশে এনে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের বন্দী বিনিময় চুক্তির আলোকে পি কে হালদারকে দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ রয়েছে। তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হবে। কারণ তিনি জনগণের টাকা পাচার করেছেন। ভারতে বিভিন্ন জালিয়াতির মাধ্যমে অবস্থান করে আসছিলেন। সেটা তাদের নিজস্ব বিষয়। কিন্তু আমাদের যে অর্থপাচারের বিষয়টা, আর্থিক কেলেঙ্কারির বিষয় আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। সেই মামলায় তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। আশা করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যে তাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। আরেক প্রশ্নের জবাবে এ আইন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের এজেন্সিগুলোর দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে পি কে হালদারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংস্থাগুলো পি কে হালদারের বিষয়ে তৎপর। তৎপরতার কারণেই তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে। আমাদের দেশের যে টাকা ভারতে পাচার করা হয়েছে। আমরা তা ফেরত আনার চেষ্টা করব। কারণ, এটা জনগণের টাকা। রবিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম আয়োজিত এক সেমিনারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, পিকে হালদার বাংলাদেশের ওয়ান্টেড ব্যক্তিত্ব। আমরা ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাকে অনেকদিন ধরেই চাচ্ছি। সে এ্যারেস্ট (ভারতে) হয়েছে। আমাদের কাছে এখনও অফিসিয়ালি কিছু আসেনি। এলে আমাদের যা কাজ, আমরা আইনগতভাবে করব।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2013-2022 dainikdristipat.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com