এফএনএস : শিল্পক্ষেত্রে বাংলাদেশ দিন দিন অগ্রগতি করছে, যদিও এই অগ্রগতির চাকা ঘুরছে ধীর গতিতে। কোন দেশের শিল্পোন্নত হওয়ার মূল শর্ত হচ্ছে জ¦লানীর অবিচ্ছিন্ন সরবরাহ। বাংলাদেশ এই জায়গাটায় পিছিয়ে আছে। জ¦লানী সংকট। স¤প্রতি এই সংকট আরও প্রকট হয়েছে। জানা যায়, কারখানাগুলো চরম গ্যাস সংকটে ভুগছে। এতে উৎপাদন কমে গেছে মারাত্মকভাবে। কারখানাগুলোয় সাধারণত যে পরিমাণ গ্যাস দরকার তার চাইতে খুব কম পরিমাণ সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এই অল্প সরবরাহের মধ্যেও শুরু হয়েছে বিঘœ। জ¦ালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এবং পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, দেশে বর্তমানে দৈনিক ৪৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। এর বিপরীতে ২৫০ থেকে ২৭৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। গত ২-৩ বছর ধরে দৈনিক ৪১০-৪৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে ৩১০-৩৩০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছিল। সা¤প্রতিক সময়ে গত ৪ এপ্রিল ২৯৫ কোটি ঘনফুট, গত ১ আগস্ট ২৮৪ কোটি ঘনফুট এবং গত ৯ জানুয়ারি ২৫৬ কোটি গ্যাস সরবরাহ করা হয়। মূলত: উৎস থেকে গ্যাস কম পাওয়ার কারণেই সরবরাহে এ ঘাটতি কমতে শুরু করে। মোটা দাগে চারটি কারণে চাহিদা ও সরবরাহ ঘাটতি বাড়তে শুরু করে। এগুলো হলো- দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে প্রমাণিত মজুদ কমতে থাকা, বিশ^বাজারে এলএনজির (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) দাম বাড়তে থাকা, দেশে চালুথাকা দুইটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনালের মধ্যে একটি গত নভেম্বরে অকার্যকর হয়ে যাওয়া এবং সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানায় ক‚প সংস্কার কাজ চলা। সূত্র জানায়, ঢাকার সাভারে পোশাক শিল্পের তিনটি কারখানার প্রতিটির জন্য অনুমোদিত গ্যাসের চাপ ১৫ পিএসআই (প্রতি বর্গইঞ্চিতে গ্যাসের চাপের ইউনিট)। অথচ জানুয়ারি জুড়ে এগুলো শূণ্য থেকে ৬ পিএসআই চাপে গ্যাস পেয়েছে। একই অবস্থা নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত একটি স্পিনিং এবং আরেকটি টেক্সটাইল মিলের। এ দুইটি কারখানার জন্যও ১৫ পিএসআই চাপের গ্যাস বরাদ্দ থাকলেও গত মাসে সর্বোচ্চ ৪ পিএসআই চাপে গ্যাস পেয়েছে। কখনও কখনও কোনো গ্যাসই পায়নি। এ কারখানাগুলো মতো গ্যাস সংকটে ভুগছে দেশের প্রায় সব শিল্প কারখানা। চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস না পেয়ে উৎপাদন কমেছে সেগুলোতে। গ্যাসের এই দৈন্য দশায় টেক্সটাইল কারখানাগুলো করুণ অবস্থায় নিপতিত হয়েছে। জানা যায়, গড়ে এ খাতে উৎপাদন কমে গেছে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ। এ ছাড়া কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন কমেছে প্রায় ৭০ শতাংশ। স্পিনিং, উইভিং ও ডাইং-প্রিন্টিং-ফিনিশিং মিলের অধিকাংশই নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র (ক্যাপটিভ পাওয়ার) উৎপাদনের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। যেখানে মূল জ¦ালানি গ্যাস। গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে। ফলে যেসব টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি ক্যাপটিভ পাওয়ার জেনারেশনের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে তাদের উৎপাদন প্রায়বন্ধ। এ অবস্থা চলতে থাকলে রপ্তানি খাতের এ শিল্পে চরম বিপর্যয় নেমে আসবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। দ্রুত জাতীয় গ্রিডে নিরবচ্ছিন্ন এলএনজি সরবরাহের দাবিও জানান তারা। এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি শিল্প হলো তৈরি পোশাক। এই খাতে বাংলাদেশের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। বর্তমানে তৈরি পোশাক কারখানায় প্রচুর ক্রয়াদেশ রয়েছে। সেটি আগামী ছয় মাস পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে ধারণা করছেন তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকেরা। ভরপুর ক্রয়াদেশের প্রতিফলনও তৈরি পোশাক রপ্তানিতেও দেখা যাচ্ছে। গত ডিসেম্বরে ৪০৪ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা দেশের ইতিহাসে এক মাসে সর্বোচ্চ। ওই মাসে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫২ দশমিক ৫৭ শতাংশ। তবে গ্যাস সংকটের কারণে প্রধান এই রপ্তানি শিল্পও হুমকির মুখে পড়েছে। জানা যায়, গ্যাস দুষ্প্রাপ্যতার জন্য কোনাবাড়ী, সাভার, আশুলিয়াসহ কয়েকটি এলাকার ডাইং ও ওয়াশিং কারখানা পূর্ণ সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারছে না। এ বিষয়ে পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদউলাহ আজিমের ভাষ্য, গ্যাস-সংকটে ইতোমধ্যে ঝামেলা শুরু হয়ে গেছে। সময়মতো উৎপাদন করতে না পারায় অনেকেই নিজ খরচে উড়োজাহাজে পণ্য পাঠাতে বাধ্য হচ্ছেন। তাতে কারখানাগুলো দেনার দায়ে জর্জরিত হচ্ছে। বাংলাদেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলোর মধ্যে সচল বা নিয়মিত গ্যাস উৎপাদন করে খুব কম। অনেকগুলো সংস্কারের অভাবেও অকার্যকর অবস্থায় পড়ে আছে। নতুন করে আবিষ্কৃতও হচ্ছে না উৎপাদনশীল কোন গ্যাসক্ষেত্র। জ¦ালানি বিভাগের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে ২৮টি গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে। এর মধ্যে ২০টি গ্যাসক্ষেত্রের ১০৪টি গ্যাসক‚প থেকে প্রতিদিন ২ হাজার ৩৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন হয়। এ ছাড়া গড়ে আরও ৭শ মিলিয়ট ঘনফুট লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাস (এলএনজি) বিদেশ থেকে আমদানি করে দেশীয় গ্যাসের সঙ্গে মিশিয়ে পাইপলাইনে সরবরাহ করা হচ্ছে। অর্থাৎ বর্তমানে প্রায় চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে প্রতিদিন সরবরাহ হচ্ছে তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। ঘাটতি থেকে যাচ্ছে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। এ বিশাল ঘাটতি শিল্পে উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। গ্যাসের এই তীব্র সংকট দূর করতেই সরকার ২০১৮ সাল থেকে এলএনজি (তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি শুরু করে। দুটি এলএনজি টার্মিনালের মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহের সক্ষমতা রয়েছে দেশে। কিন্তু এ পর্যন্ত ৭৫০ এমএমসিএফডি থেকে ৮০০ এমএমসিএফডির বেশি গ্যাস সরবরাহ করা যায়নি। সরকার কাতার এবং ওমান থেকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে এলএনজি আমদানি করছে। এ ছাড়া স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কিনেও সরবরাহ করেছে। তবে গত বছরের জুন থেকে বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় স্পট মার্কেট থেকে তা কেনা বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় হঠাৎ করে গ্যাস সংকট প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশের গন্ডি পেরিয়ে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের খাতায় নাম লিখিয়েছে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে শিল্পচাহিদা বাড়ছে। কিন্তু গ্যাসের এই সংকটের কারণে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা হতাশ হয়ে পড়ছেন। অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা ধরে রাখতে হলে জ¦ালানির সরবরাহ নিশ্চিত করার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, পরিকল্পিতভাবে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ না নিলে দিন পরিস্থিতি খারাপ হবে, যা সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যেতে পারে। দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন কমছে। সামনে এলএনজির ওপর নির্ভরতা আরও বাড়বে। তাই এলএনজি কেনার ক্ষেত্রে একটি বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করা যেতে পারে। কারণ শিল্প চাহিদার কথা মাথায় রাখলে দাম যতই বাড়ুক এলএনজি কিনতেই হবে। তাই স্পট মার্কেট আর দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মধ্যে সমন্বয় করে কেনাকাটা করতে হবে। তবে দেশি উৎস থেকে গ্যাস অনুসন্ধানে বেশি জোর দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তাঁরা।