জি এম শাহনেওয়াজ ঢাকা থেকে \ দেশের এখন সম্ভাবনাময়খাত নৌপথ। এ লক্ষ্যে পথনকশা প্রণয়ন করছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়। বর্তমান পথগুলোকে ধরে রাখা। পাশাপাশি নতুন নৌপথের খোঁজে মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীন নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এবং বাংলাদেশ অভ্যন্তরীন নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) যৌথভাবে এই মহাপরিকল্পনা তৈরি করছে। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা সেল সংস্থা দুটির কাজে সমন্বয় করছে। মোটা অংকের অর্থ বিনিয়োগ করা হচ্ছে সম্ভাবনাময় নতুন এই পথের সন্ধানে। একই সঙ্গে ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের উৎস জরিপ করা হচ্ছে। বরাদ্দের টাকা যাতে অপচয় না হয়; সেজন্য সতর্ক রয়েছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অভিভাবক প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। কতদিনের মধ্যে পরিকল্পনা অনুযায়ী বাণিজ্যিক কার্যক্রমে যাওয়া যাবে, সে লক্ষ্যে সুনিদিষ্ট দিনক্ষণ ঠিক করে এগোচ্ছে না মন্ত্রণালয়। তবে, সম্ভাব্য পরিকল্পনায় যাতে একদিনও বাড়তি সময় ও অর্থ ব্যয় না হয়, সে দিকটি-ও কঠোরভাবে করা হচ্ছে নজরদারি। সূত্র জানিয়েছে, যদি নতুন নৌপথ চালু করা যায় তাহলে আয়ের ক্ষেত্র বাড়বে মন্ত্রণালয়ের। এর সুফল পাবে সরকার-ও। কারণ নতুন নৌপথ থেকে বড় অংকের রাজস্ব আয় হবে। কারণ নতুন ঘাট তৈরির কাজ করে থাকে টিএ এবং ফেরি সার্ভিসের সঙ্গে সম্পৃক্ত টিসি। নতুন নৌপথ হলে দুটি সংস্থারই কাজের ক্ষেত্র বাড়বে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, ঘাট ইজারা দিয়ে টিএ সরকারের রাজস্ব আয়ে বড় ভূমিকা রাখে। পাশাপাশির টিসির যত আয় আসে তার মধ্যে ফেরিই লাভজনক। এই যন্ত্রের আয়ে টিসির কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেতনভাতা হয়। ফলে নতুন নৌপথ দুটি সংস্থার জন্য নতুন করে সুফল বয়ে আনবে বলে মনে করছেন সংশ্লিস্টরা। এদিকে বর্তমান ভিশনারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নদীমাতৃক বাংলাদেশের সুনাম ফিরিয়ে আনতে তরুণ-উদ্দমী ও দক্ষ সংগঠক খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর প্রতি আস্থা রেখে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। দায়িত্ব নিয়েই নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেন। এতে তলানিতে যাওয়া নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের ভাবমূর্তি বাড়ে। এর পর সরকারের ঘোষনা অনুযায়ী সারাদেশে ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ আবিস্কারের বিশাল কর্মযজ্ঞ হাতে নেয়া হয়। ইতিমধ্যে ৭ হাজার নতুন নৌপথ তৈরি হয়েছে বলে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। বাকি ৩ হাজার কিলোমিটার নৌপথ তৈরির কাজ চলমান রয়েছে। নতুন নৌপথ তৈরি হলে নদী মাতৃক বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনার দ্বার খুলবে এমনটাই প্রত্যাশা মন্ত্রণালয়ের। এরই মধ্যে আগামী ২৫ জুন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের গর্ব ও স্বপ্নের পদ্মাসেতুর উদ্বোধনের দিনক্ষণ ঠিক হয়েছে। এ সেতু ঘিরে ওই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে কর্মচাঞ্চল্য ফিরেছে। বিশেষ ব্যবসায়ী মহলের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। কিন্তু নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের আয়ের উৎস ফেরি, লঞ্চ ও স্প্রীড বোর্ড সেতুর চালু পর সচল থাকবে কি না এ নিয়েও নানা মহলে ছিল জোর আলোচনা-সমালোচনা। তবে নৌমন্ত্রণালয় পণ্য-পরিবহনকারী যানবাহন ও সাধারণ যাত্রীদের নদী ভ্রমণের মাধ্যমে নৌপথ ব্যবহারের চিন্তা করে এ পথেই চালু রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংশ্লিষ্ট যানগুলোকে। তবে ফেরির সংখ্যা কমিয়ে আনা হচ্ছে। পদ্মাসেতুর কাজ চলমান অবস্থায় ২২টি ফেরি থাকলেও সেতু চালুর পর এই রুটে চাহিদানুযায়ী সীমিত সংখ্যাক ফেরি রাখার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বর্তমানে ৮টি ফেরি চলছে পদ্মাসেতু এলাকায়। এদিকে, উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চল মিলিয়ে বেশ কিছু নতুন নৌপথ চালু করার জন্য মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে কুড়িগ্রামের রৌমারী-চিলমারী নৌরুট, মাদারগঞ্জ-সারিয়াকান্দি এবং বালাসি-বাহাদুরাবাদ এই রুটে নতুনভাবে নৌপথ তৈরি করা হচ্ছে। এতে উত্তরাঞ্চলের বিরাট একটি অংশের মানুষ বড় ধরণের সুবিধা পাবেন। কময় সময়ে ঢাকায় পৌঁছাতে পারবেন এই রুটগুলো ব্যবহার করে। এতে নৌমন্ত্রণালয়ের আয়ের পথ উন্মুক্ত হবে। এ ছাড়া আরও বেশকিছু নতুন নৌপথ চালু করার জন্য পথ খোঁজার কাজে নিয়োজিত আছে মন্ত্রণালয়। নানা কারণে এই নৌপথ অবহেলিত ছিল। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার এটাকে সম্ভাবনাময়খাতে নিয়ে এসেছে। বরাদ্দ বেড়েছে মন্ত্রণালয়ের। প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, রৌমারি চিলমারি, সিরাজগঞ্জ-টাংগাইল, রাজবাড়ির সঙ্গে পাবনা, বরিশালের বাকেরগঞ্জ, সন্ধানদী, পিরোজপুর এবং পটুয়াখালী কলাপাড়ায় নতুন নৌপথের চাহিদা রয়েছে। এ ছাড়া রাঙাবালি ও দশমিনায় সম্ভাবনা আছে। আমরা এসব সম্ভাবনাময়খাতগুলো নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা (স্টাডি) করছি। এসব রুটে ফেরি দেওয়া হবে। এ জন্য ফেরির সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। মন্ত্রী আরও বলেন, হরিণা-আলু বাজার এলাকায় এখন যে ফেরি চলছে এই রুটে আরও বেশি চাহিদা রয়েছে। বলেন, সবগুলো রুটের সম্ভাব্য স্টাডি শেষ হলে তখন বলা যাবে নতুন কতগুলো পথ তৈরি হলো। তিনি বলেন, শুধু চাহিদা থাকলে তো হবে না আমাদের অবকাঠামো থাকতে হবে; সেগুলোর আমাদের একটা প্রস্তুতি চলছে। এ সংক্রান্ত কার্যক্রম চলমান আছে। কতদিনের মধ্যে চালু করা হবে তার কোন দিনক্ষণ বলা যাবে না বলে জানান প্রতিমন্ত্রী। টিসির পরিচালক এস এম আশিকুর রহমান বলেন, পদ্মাসেতু চালু হচ্ছে। এটার সঙ্গে আমাদের দক্ষিণ বঙ্গের ১১টি জেলার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন হবে। সেখানে আমাদের ফেরির যে রুটগুলো রয়েছে সেগুলোকে আরও সংহত করব। শক্তিশালী করব। চাঁদপুর-শরিয়তপুর যে রুটটি রয়েছে সেখানে ফেরির সংখ্যা বাড়াবো। কারণ এই পথে অনেক গাড়ির চাপ থাকে। তিনি বলেন, ভোলা-ল²ীপুর যে রুটটি রয়েছে সেখানেও ফেরির সংখ্যা বাড়িয়ে দিব। ওখানেও ফেরির স্বল্পতা রয়েছে। আর আরিচা-কাজিরহাট যে রুটটি রয়েছে এখানেও ফেরি সংখ্যা বাড়ানো হবে। এর বাইরেও আমরা কিছু নতুন রুট চালু করার চেষ্টা করছি। এর মধ্যে রৌমারী-চিলমারী নৌ-রুট। উত্তরবঙ্গের উত্তর-পশ্চিম অংশের যে জেলাগুলো রয়েছে তার মধ্যে দিনাজপুর, রংপুর, পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁও ওই অঞ্চলের মানুষের ঢাকাতে আসতে চাইলে পরিবহনগুলোকে বঙ্গবন্ধু সেতু (যমুনা) ঘূরে আসতে হয়। যদি নতুন পথ তৈরি করে দেওয়া যায়, তাহলে রৌমারির সঙ্গে চিলমারী ফেরি দিয়ে যাত্রীবাহী বাস ও পণ্যবাহী পরিবহনগুলোকে এ রুটটি দিয়ে সহজেই পার হতে পারবে। এর ফলে জামালপুর-বকশিগঞ্জ-ময়মনসিংহ হয়ে ঢাকায় ওই অঞ্চলের মানুষ সহজেই আসতে পারবেন। এই নৌপথটি চালু করা হলে অত্র এলাকার মানুষের সময়-অর্থ দুটিই সাশ্রয় হবে। প্রায় দুই থেকে আড়াইঘন্টা সময় বাঁচবে। তিনি বলেন, এর পর নতুন আরেকটি রুট নিয়ে কাজ করছি; রুটটির নাম বালাসি-বাহাদুরাবাদ। এখন ব্রক্ষপুত্র ও যমুনার দিকে আমরা বেশি নজর দিচ্ছি। কারণ ওই অঞ্চলে বঙ্গবন্ধু সেতু ছাড়া অন্য কোন সেতু নেই। আরেকটি আছে মাদারগঞ্জ-সারিয়াকান্দি। এই রুটটি কাজ করছে বিআইডব্লিউটিএ। এছাড়া উপকূলীয় এলাকা নিয়ে আমরা চিন্তা করতেছি। মন্ত্রণালয়ের পথ-নকশানুযায়ী নতুন নৌপথ তৈরি করা সম্ভব হলে নদী-মাতৃক বাংলাদেশের সুনাম ফিরে আসবে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক বলেছিলেন, কোন নৌপথই অব্যবহ্নত থাকবে না। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় নৌপথ হবে রাজস্ব আয়ের বড় একটি উৎস। এ লক্ষ্যে নতুন নৌপথের খোঁজে আমরা কাজ করছি। সব পরিকল্পনা চূড়ান্ত হলে আপনাদের জানানো হবে।