এফএনএস : উড়োজাহাজে ব্যবহৃত জ¦ালানি জেট ফুয়েলের ক্রমাগত বাড়ছে। দুই বছর আগে যেখানে প্রতি লিটারের দাম ছিল ৪৬ টাকা, এখন একই ফুয়েলের সরকার নির্ধারিত দাম ১০৬ টাকা লিটার। এভাবে গত ১৮ মাসে জেট ফুয়েলের দাম বেড়েছে প্রায় ১২২ শতাংশ। এতে যাত্রী পরিবহন খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে উড়োজাহাজ সংস্থাগুলো। দেড় বছর আগে যে রুটের ভাড়া ছিল আড়াই হাজার বা এর একটু বেশি, সেই ভাড়া গিয়ে ঠেকেছে প্রায় পাঁচ হাজারে। জেট ফুয়েলের দাম বাড়ার ফলে আরেক দফা ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশের এয়ারলাইন্সগুলো, অনেকগুলো ইতোমধ্যে ভাড়া বাড়িয়েও ফেলেছে। জানা যায়, করোনা মহামারির আগে যখন জেট ফুয়েলের দাম ৪৬ টাকা লিটার ছিল, তখন ঢাকা-যশোর রুটে সর্বনিম্ন ভাড়া ছিল দুই হাজার ৭০০ টাকা। এটা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৮শ টাকায়। একইভাবে ঢাকা-কক্সবাজার রুটে সর্বনিম্ন ভাড়া ছিল তিন হাজার ৭শ, এখন পাঁচ হাজার ৮শ টাকা। দুই হাজার ৭শ টাকা থেকে বেড়ে ঢাকা-সৈয়দপুরের ভাড়া এখন চার হাজার ৮শ টাকা। চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহীর ভাড়া হয়েছে সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার টাকা। করোনার আগে যা ছিল দুই হাজার ৭শ টাকা। এখন এই ভাড়া আরও বাড়ানোর প্রস্তুতি চলছে। দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে আকাশপথে এখন যাত্রী পরিবহন করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেড, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ও নভোএয়ার। ফ্লাই ঢাকা ও এয়ার অ্যাস্ট্রা নামে আরও দুটি উড়োজাহাজ সংস্থা অভ্যন্তরীণ যাত্রী পরিবহনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু যে হারে জেট ফুয়েলের দাম বাড়ছে, এমন পরিস্থিতিতে এয়ারলাইন্সগুলোর টিকে থাকাই কঠিন হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশের এয়ারলাইন্সগুলো বলছে, প্লেন ভাড়ার ৪০ শতাংশ নির্ধারণ হয় জেট ফুয়েলের ওপর। গত প্রায় দুই বছরে এই জেট ফুয়েলের দাম বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। এতে অভ্যন্তরীণ রুটে ভাড়াও বেড়ে হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। এভাবে বাড়তে থাকলে আকাশপথে যাতায়াতে যাত্রীদের ব্যয় আরও বাড়বে। তৈরি হবে নেতিবাচক ধারণা। একপর্যায়ে এয়ারলাইন্সগুলো মুখ থুবড়ে পড়বে। তাই সরকারকে ভর্তুকি দিয়ে হলেও জেট ফুয়েলের দাম কমানো উচিত। জানা যায়, জেট ফুয়েলের দাম বাড়ানো-কমানোর কাজটি করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। মাঠ পর্যায়ে বিপণনের কাজটি করে বিপিসির সহযোগী প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েল। বিপিসি ও পদ্মা অয়েল কোম্পানির সংশ্লিষ্টরা জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রমেই বাড়ছে জ¦ালানি তেলের দাম। এখন জেট ফুয়েলের আন্তর্জাতিক মূল্য প্রতি লিটার ১ দশমিক শূন্য ৪ ডলার। এই হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারেই এখন জেট ফুয়েলের দাম লিটারপ্রতি ১২৫ থেকে ১২৬ টাকা। সরকার ভর্তুকি দিয়ে ১০৬ টাকা লিটার দরে বিক্রি করছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে না কমলে জেট ফুয়েলের দাম কমানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। ২০২১ সালে জেট ফুয়েলের চাহিদা ছিল তিন লাখ ১৯ হাজার ৭০৮ মেট্রিক টন, যার পুরোটাই আমদানিনির্ভর। জানা যায়, গত জানুয়ারিতে প্রতি লিটার জেট ফুয়েলের দাম ছিল ৭৩ টাকা। ৯ ফেব্র“য়ারি আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার অজুহাতে ৭ টাকা বাড়ানো হয়। ৮ মার্চ প্রতি লিটার ৮০ টাকা থেকে বেড়ে ৮৭ টাকা নির্ধারণ করে বিপিসি। পরে ৭ এপ্রিল আবার ১৩ টাকা বাড়িয়ে প্রতি লিটার জেট ফুয়েলের দাম ১০০ টাকা করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। সবশেষ গত ১৫ মে বাড়ানো হয় আরও ৬ টাকা। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) ওয়েবসাইটে জেট ফুয়েলের মূল্যতালিকা থেকে জানা যায়, গত ১৫ মে থেকে জেট ফুয়েলের নতুন মূল্যতালিকা কার্যকর হয়েছে। এই তালিকা অনুযায়ী জেট ফুয়েলের দাম স্থানীয় ফ্লাইটের ক্ষেত্রে প্রতি লিটার ১০৬ টাকা এবং আন্তর্জাতিক রুটের জন্য ১০৯ টাকা। এর প্রভাব পড়ছে ফ্লাইট ভাড়ায়। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) মো. কামরুল ইসলাম বলেন, এখন পর্যটনে অফ মৌসুম। দেশের অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে যাত্রী সংখ্যা কম। এর মধ্যে জেট ফুয়েলের দাম বাড়লে ভাড়া বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। কারণ উড়োজাহাজ পরিচালন ব্যয়ের ৪০ শতাংশই জ¦ালানি খরচ। ভাড়া বাড়ালে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তিনি বলেন, করোনার সময় বিশ্বের সব দেশে প্লেন চলাচল বন্ধ ছিল। তখন পর্যটন খাত তথা হোটেল এবং শিল্প কারখানাও বন্ধ ছিল। এতে দেশের অর্থনীতিতে তার প্রভাব পড়েছে। এখন এয়ারলাইন্সগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে দেশের অন্যান্য সেক্টরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই সরকারের উচিত জেট ফুয়েলের দাম কমানো এবং এই খাতে ভ্যাট কমিয়ে আরও ভর্তুকি দেওয়া। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে বিপিসি তো দাম বাড়াতেই পারে, এ প্রসঙ্গে কামরুল ইসলাম বলেন, করোনার সময় বিনা কারণে জেট ফুয়েলের দাম দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে। তখন আন্তর্জাতিক বাজারে ফুয়েলের দাম বাড়েনি। এখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাতে বলা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে ফুয়েলের দাম বেড়েছে। যদি বেড়েও থাকে সরকারের উচিত এই সেক্টরকে বাঁচিয়ে রাখতে একটা পথ বের করা। এদিকে প্রতি মাসে ধাপে ধাপে জেট ফুয়েলের দাম বাড়ায় দেশের অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান ভাড়া ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এতে অভ্যন্তরীণ রুটে বিমানের ফ্লাইট ও যাত্রী সংখ্যা কমছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশের বিমান সংস্থাগুলো মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এখন করোনার আগের তুলনায় ভাড়া প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এভাবে ভাড়া বাড়তে থাকলে আকাশপথে ভ্রমণকারীর সংখ্যা কমার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া পর্যটনশিল্পের ওপরও প্রভাব পড়বে। মানুষ ভ্রমণবিমুখ হবে। ফলে পিছিয়ে পড়বে দেশের পর্যটনখাতও।